Friday, February 14, 2014

ল্যাবরেটরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নন্দকিশোর ছিলেন লণ্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাস করা এঞ্জিনীয়ার। যাকে সাধুভাষায় বলা যেতে পারে দেদীপ্যমান ছাত্র অর্থাৎ ব্রিলিয়ান্ট, তিনি ছিলেন তাই। স্কুল থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার তোরণে তোরণে ছিলেন পয়লা শ্রেণীর সওয়ারী।
ওঁর বুদ্ধি ছিল ফলাও, ওঁর প্রয়োজন ছিল দরাজ, কিন্তু ওঁর অর্থসম্বল ছিল আঁটমাপের।
রেলওয়ে কোম্পানির দুটো বড়ো ব্রিজ তৈরি করার কাজের মধ্যে উনি ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন। ও-কাজের আয়ব্যয়ের বাড়তি-পড়তি বিস্তর, কিন্তু দৃষ্টান্তটা সাধু নয়। এই ব্যাপারে যখন তিনি ডানহাত বাঁহাত দুই হাতই জোরের সঙ্গে চালনা করেছিলেন তখন তাঁর মন খুঁতখুঁত করে নি। এ-সব কাজের দেনাপাওনা নাকি কোম্পানি-নামক একটা অ৻াবস্ট্রাক্ট সত্তার সঙ্গে জড়িত, সেইজন্যে কোনো ব্যক্তিগত লাভলোকসানের তহবিলে এর পীড়া পৌঁছয় না।
ওঁর নিজের কাজে কর্তারা ওঁকে জীনিয়স বলত, নিখুঁত হিসাবের মাথা ছিল তাঁর। বাঙালি বলেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক তাঁর জোটে নি। নীচের দরের বিলিতি কর্মচারী প্যান্টের দুই ভরা-পকেটে হাত গুঁজে যখন পা ফাঁক করে 'হ্যালো মিস্টার মল্লিক' ব'লে ওঁর পিঠ-থাবড়া দিয়ে কর্তাত্বি করত তখন ওঁর ভালো লাগত না। বিশেষত যখন কাজের বেলা ছিলেন উনি, আর দামের বেলা আর নামের বেলা ওরা। এর ফল হয়েছিল এই যে, নিজের ন্যায্য প্রাপ্য টাকার একটা প্রাইভেট হিসেব ওঁর মনের মধ্যে ছিল, সেটা পুষিয়ে নেবার ফন্দি জানতেন ভালো করেই।
পাওনা এবং অপাওনাদার টাকা নিয়ে নন্দকিশোর কোনোদিন বাবুগিরি করেন নি। থাকতেন শিকদারপাড়া গলির একটা দেড়তলা বাড়িতে। কারখানাঘরের দাগ-দেওয়া কাপড় বদলাবার ওঁর সময় ছিল না। কেউ ঠাট্টা করলে বলতেন, 'মজুর মহারাজের তকমা-পরা আমার এই সাজ।' কিন্তু বৈজ্ঞানিক সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্যে বিশেষ করে তিনি বাড়ি বানিয়েছিলেন খুব মস্ত। এমন মশগুল ছিলেন নিজের শখ নিয়ে যে, কানে উঠত না লোকেরা বলাবলি করছে, এত বড়ো ইমারতটা যে আকাশ ফুঁড়ে উঠল-- আলাদিনের প্রদীপটা ছিল কোথায়।
এক-রকমের শখ মানুষকে পেয়ে বসে সেটা মাতলামির মতো, হুঁশ থাকে না যে লোকে সন্দেহ করছে। লোকটা ছিল সৃষ্টিছাড়া, ওঁর ছিল বিজ্ঞানের পাগলামি। ক্যাটালগের তালিকা ওলটাতে ওলটাতে ওঁর সমস্ত মনপ্রাণ চৌকির দুই হাতা আঁকড়ে ধরে উঠত ঝেঁকে ঝেঁকে। জর্মানি থেকে আমেরিকা থেকে এমন-সব দামী দামী যন্ত্র আনাতেন যা ভারতবর্ষের বড়ো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেলে না। এই বিদ্যালোভীর মনে সেই তো ছিল বেদনা। এই পোড়াদেশে জ্ঞানের ভোজের উচ্ছিষ্ট নিয়ে সস্তা দরের পাত পাড়া হয়। ওদের দেশে বড়ো বড়ো যন্ত্র ব্যবহারের যে সুযোগ আছে আমাদের দেশে না থাকাতেই ছেলেরা টেক্সট্‌বুকের শুকনো পাতা থেকে কেবল এঁটোকাঁটা হাতড়িয়ে বেড়ায়। উনি হেঁকে উঠে বলতেন, ক্ষমতা আছে আমাদের মগজে, অক্ষমতা আমাদের পকেটে। ছেলেদের জন্যে বিজ্ঞানের বড়ো রাস্তাটা খুলে দিতে হবে বেশ চওড়া ক'রে, এই হল ওঁর পণ। দুর্মূল্য যন্ত্র যত সংগ্রহ হতে লাগল, ওঁর সহকর্মীদের ধর্মবোধ ততই অসহ্য হয়ে উঠল। এই সময়ে ওঁকে বিপদের মুখ থেকে বাঁচালেন বড়োসাহেব। নন্দকিশোরের দক্ষতার উপর তাঁর প্রচুর শ্রদ্ধা ছিল। তা ছাড়া রেলওয়ে কাজে মোটা মোটা মুঠোর অপসারণদক্ষতার দৃষ্টান্ত তাঁর জানা ছিল। চাকরি ছাড়তে হল। সাহেবের আনুকূল্যে রেল-কোম্পানির পুরনো লোহালক্কড় সস্তা দামে কিনে নিয়ে কারখানা ফেঁদে বসলেন। তখন য়ুরোপের প্রথম যুদ্ধের বাজার সরগরম। লোকটা অসামান্য কৌশলী, সেই বাজারে নতুন নতুন খালে নালায় তাঁর মুনফার টাকায় বান ডেকে এল। এমন সময় আর-একটা শখ পেয়ে বসল ওঁকে।
এক সময়ে নন্দকিশোর পাঞ্জাবে ছিলেন তাঁর ব্যবসার তাগিদে। সেখানে জুটে গেল তাঁর এক সঙ্গিনী। সকালে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, বিশ বছরের মেয়েটি ঘাগরা দুলিয়ে অসংকোচে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত-- জ্বলজ্বলে তার চোখ, ঠোঁটে একটি হাসি আছে, যেন শান-দেওয়া ছুরির মতো। সে ওঁর পায়ের কাছে ঘেঁষে এসে বললে, 'বাবুজি, আমি কয়দিন ধরে এখানে এসে দু'বেলা তোমাকে দেখছি। আমার তাজ্জব লেগে গেছে।'
নন্দকিশোর হেসে বললেন,'কেন, এখানে তোমাদের চিড়িয়াখানা নেই নাকি।'
সে বললে, 'চিড়িয়াখানার কোনো দরকার নেই। যাদের ভিতরে রাখবার, তারা বাইরে সব ছাড়া আছে। আমি তাই মানুষ খুঁজছি।'
'খুঁজে পেলে?'
নন্দকিশোরকে দেখিয়ে বললে, 'এই তো পেয়েছি।'
নন্দকিশোর হেসে বললেন,'কী গুণ দেখলে বলো দেখি।'
ও বললে, 'এখানকার বড়ো বড়ো সব শেঠজি, গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে হীরার আংটি, তোমাকে ঘিরে এসেছিল-- ভেবেছিল বিদেশী, বাঙালি, কারবার বোঝে না। শিকার জুটেছে ভালো। কিন্তু দেখলুম তাদের একজনেরও ফন্দি খাটল না। উলটে ওরা তোমারই ফাঁসকলে পড়েছে। কিন্তু তা ওরা এখনো বোঝে নি, আমি বুঝে নিয়েছি।'
নন্দকিশোর চমকে গেল কথা শুনে। বুঝলে একটি চিজ বটে-- সহজ নয়।
মেয়েটি বললে, 'আমার কথা তোমাকে বলি, তুমি শুনে রাখো। আমাদের পাড়ায় একজন ডাকসাইটে জ্যোতিষী আছে। সে আমার কুষ্টি গণনা করে বলেছিল, একদিন দুনিয়ায় আমার নাম জাহির হবে। বলেছিল আমার জন্মস্থানে শয়তানের দৃষ্টি আছে।'
নন্দকিশোর বললে, 'বল কী। শয়তানের?'
মেয়েটি বললে, 'জানো তো বাবুজি, জগতে সব চেয়ে বড়ো নাম হচ্ছে ঐ শয়তানের। তাকে যে নিন্দে করে করুক, কিন্তু সে খুব খাঁটি। আমাদের বাবা বোম্‌ভোলানাথ ভোঁ হয়ে থাকেন। তাঁর কর্ম নয় সংসার চালানো। দেখো-না, সরকার বাহাদুর শয়তানির জোরে দুনিয়া জিতে নিয়েছে, খৃস্টানির জোরে নয়। কিন্তু ওরা খাঁটি, তাই রাজ্য রক্ষা করতে পেরেছে। যেদিন কথার খেলাপ করবে, সেদিন ঐ শয়তানেরই কাছে কানমলা খেয়ে মরবে।'
নন্দকিশোর আশ্চর্য হয়ে গেল।
মেয়েটি বললে, 'বাবু, রাগ কোরো না। তোমার মধ্যে ঐ শয়তানের মন্তর আছে। তাই তোমারই হবে জিত। অনেক পুরুষকেই আমি ভুলিয়েছি, কিন্তু আমার উপরেও টেক্কা দিতে পারে এমন পুরুষ আজ দেখলুম। আমাকে তুমি ছেড়ো না বাবু, তা হলে তুমি ঠকবে।' নন্দকিশোর হেসে বললে, 'কী করতে হবে।'
'দেনার দায়ে আমার আইমার বাড়িঘর বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তোমাকে সেই দেনা শোধ করে দিতে হবে।'
'কত টাকা দেনা তোমার।'
'সাত হাজার টাকা।'
নন্দকিশোরের চমক লাগল, ওর দাবির সাহস দেখে। বললে, 'আচ্ছা আমি দিয়ে দেব, কিন্তু তার পরে?'
'তার পরে আমি তোমার সঙ্গ কখনো ছাড়ব না।'
'কী করবে তুমি।'
'দেখব, যেন কেউ তোমায় ঠকাতে না পারে আমি ছাড়া।'
নন্দকিশোর হেসে বললেন, 'আচ্ছা বেশ, রইল কথা, এই পরো আমার আংটি।'
কষ্টিপাথর আছে ওঁর মনে, তার উপরে দাগ পড়ল একটা দামী ধাতুর। দেখতে পেলেন মেয়েটির ভিতর থেকে ঝক্‌ ঝক্‌ করছে ক্যারেক্‌টরের তেজ-- বোঝা গেল ও নিজের দাম নিজে জানে, তাতে একটুমাত্র সংশয় নেই। নন্দকিশোর অনায়াসে বললে, 'দেব টাকা'-- দিলে সাত হাজার বুড়ি আইমাকে।
মেয়েটিকে ডাকত সবাই সোহিনী ব'লে। পশ্চিমী ছাঁদের সুকঠোর এবং সুন্দর তার চেহারা। কিন্তু চেহারায় মন টলাবে, নন্দকিশোর সে জাতের লোক ছিলেন না। যৌবনের হাটে মন নিয়ে জুয়ো খেলবার সময়ই ছিল না তাঁর।
নন্দকিশোর ওকে যে-দশা থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা খুব নির্মল নয়, এবং নিভৃত নয়। কিন্তু ঐ একরোখা একগুঁয়ে মানুষ সাংবাদিক প্রয়োজন বা প্রথাগত বিচারকে গ্রাহ্য করতেন না। বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করত, বিয়ে করেছ কি। উত্তরে শুনত, বিয়েটা খুব বেশি মাত্রায় নয়, সহ্যমতো। লোকে হাসত যখন দেখত, উনি স্ত্রীকে নিজের বিদ্যের ছাঁচে গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করত, 'ও কি প্রোফেসারি করতে যাবে নাকি।' নন্দ বলতেন, 'না, ওকে নন্দকিশোরি করতে হবে, সেটা যে-সে মেয়ের কাজ নয়।' বলত, 'আমি অসবর্ণবিবাহ পছন্দ করি নে।'
'সে কী হে।'
'স্বামী হবে এঞ্জিনীয়র আর স্ত্রী হবে কোটনা-কুটনি, এটা মানবধর্মশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঘরে ঘরে দেখতে পাই দুই আলাদা আলাদা জাতে গাঁটছড়া বাঁধা, আমি জাত মিলিয়ে নিচ্ছি। পতিব্রতা স্ত্রী চাও যদি, আগে ব্রতের মিল করাও।'

নন্দকিশোর মারা গেলেন প্রৌঢ় বয়সে কোন্‌-এক দুঃসাহসিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অপঘাতে।
সোহিনী সমস্ত কারবার বন্ধ করে দিলে। বিধবা মেয়েদের ঠকিয়ে খাবার ব্যাবসাদার এসে পড়ল চার দিক থেকে। মামলার ফাঁদ ফাঁদলে আত্মীয়তার ছিটেফোঁটাআছে যাদের। সোহিনী স্বয়ং সমস্ত আইনের প্যাঁচ নিতে লাগল বুঝে। তার উপরে নারীর মোহজাল বিস্তার করে দিলে স্থান বুঝে উকিলপাড়ায়। সেটাতে তার অসংকোচ নৈপুণ্য ছিল, সংস্কার মানার কোনো বালাই ছিল না। মামলায় জিতে নিলে একে একে, দূর সম্পর্কের দেওর গেল জেলে দলিল জাল করার অপরাধে।
ওদের একটি মেয়ে আছে, তার নামকরণ হয়েছিল নীলিমা। মেয়ে স্বয়ং সেটিকে বদল করে নিয়েছে-- নীলা। কেউ না মনে করে, বাপ-মা মেয়ের কালো রঙ দেখে একটা মোলায়েম নামের তলায় সেই নিন্দেটি চাপা দিয়েছে। মেয়েটি একেবারে ফুটফুটে গৌরবর্ণ। মা বলত, ওদের পূর্বপুরুষ কাশ্মীর থেকে এসেছিল-- মেয়ের দেহে ফুটেছে কাশ্মীরী শ্বেতপদ্মের আভা, চোখেতে নীলপদ্মের আভাস, আর চুলে চমক দেয় যাকে বলে পিঙ্গলবর্ণ।
মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে কুলশীল জাতগুষ্টির কথা বিচার করবার রাস্তা ছিল না। একমাত্র ছিল মন ভোলাবার পথ, শাস্ত্রকে ডিঙিয়ে গেল তার ভেলকি। অল্প বয়সের মাড়োয়ারি ছেলে, তার টাকা পৈতৃক, শিক্ষা এ কালের। অকস্মাৎ সে পড়ল এসে অনঙ্গের অলক্ষ্য ফাঁদে। নীলা একদিন গাড়ির অপেক্ষায় ইস্কুলের দরজার কাছে ছিল দাঁড়িয়ে। সে সময় ছেলেটি দৈবাৎ তাকে দেখেছিল। তার পর থেকে আরো কিছুদিন ঐ রাস্তায় সে বায়ুসেবন করেছে। স্বাভাবিক স্ত্রীবুদ্ধির প্রেরণায় মেয়েটি গাড়ি আসবার বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেই গেটের কাছে দাঁড়াত। কেবল সেই মাড়োয়ারি ছেলে নয়, আরো দু-চার সম্প্রদায়ের যুবক ঐখানটায় অকারণ পদচারণার চর্চা করত। তার মধ্যে ঐ ছেলেটিই চোখ বুজে দিল ঝাঁপ ওর জালের মধ্যে। আর ফিরল না। সিভিল মতে বিয়ে করলে সমাজের ওপারে। বেশি দিনের মেয়াদে নয়। তার ভাগ্যে বধূটি এল প্রথমে, তার পরে দাম্পত্যের মাঝখানটাতে দাঁড়ি টানলে টাইফয়েড, তার পরে মুক্তি।
সৃষ্টিতে অনাসৃষ্টিতে মিশিয়ে উপদ্রব চলতে লাগল। মা দেখতে পায় তার মেয়ের ছটফটানি। মনে পড়ে নিজের প্রথম বয়সের জ্বালামুখীর অগ্নিচাঞ্চল্য। মন উদ্‌বিগ্ন হয়। খুব নিবিড় করে পড়াশোনার বেড়া ফাঁদতে থাকে। পুরুষ শিক্ষক রাখল না। একজন বিদুষীকে লাগিয়ে দিল ওর শিক্ষকতায়। নীলার যৌবনের আঁচ লাগত তারও মনে, তুলত তাকে তাতিয়ে অনির্দেশ্য কামনার তপ্তবাষ্পে। মুগ্ধের দল ভিড় করে আসতে লাগল এদিকে ওদিকে। কিন্তু দরওয়াজা বন্ধ। বন্ধুত্বপ্রয়াসিনীরা নিমন্ত্রণ করে চায়ে টেনিসে সিনেমায়, নিমন্ত্রণ পৌঁছয় না কোনো ঠিকানায়। অনেক লোভী ফিরতে লাগল মধুগন্ধভরা আকাশে, কিন্তু কোনো অভাগ্য কাঙাল সোহিনীর ছাড়পত্র পায় না। এদিকে দেখা যায় উৎকণ্ঠিত মেয়ে সুযোগ পেলে উঁকিঝুঁকি দিতে চায় অজায়গায়।বই পড়ে যে বই টেক্সট্‌বুক কমিটির অনুমোদিত নয়, ছবি গোপনে আনিয়ে নেয় যা আর্টশিক্ষার আনুকূল্য করে ব'লে বিড়ম্বিত। ওর বিদুষী শিক্ষয়িত্রীকে পর্যন্ত অন্যমনস্ক করে দিলে। ডায়োসিশন থেকে বাড়ি ফেরবার পথে আলুথালুচুলওয়ালা গোঁফের-রেখামাত্র-দেওয়া সুন্দরহানো এক ছেলে ওর গাড়িতে চিঠি ফেলে দিয়েছিল। ওর রক্ত উঠেছিল ছম্‌ ছম্‌ ক'রে। চিঠিখানা লুকিয়ে রেখেছিল জামার মধ্যে। ধরা পড়ল মায়ের কাছে। সমস্ত দিন ঘরে বন্ধ থেকে কাটল অনাহারে।
সোহিনীর স্বামী যাদের বৃত্তি দিয়েছিলেন, সেই-সব ভালো ভালো ছাত্রমহলে সোহিনী পাত্র সন্ধান করেছে। সবাই প্রায় আড়ে আড়ে ওর টাকার থলির দিকে তাকায়। একজন তো তার থিসিস ওর নামে উৎসর্গ করে বসল। ও বললে, 'হায় রে কপাল, লজ্জায় ফেললে আমাকে। তোমার পোস্টগ্রাজুয়েটি মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে শুনলুম, অথচ মালাচন্দন দিলে অজায়গায়, হিসাব করে ভক্তি না করলে উন্নতি হবে না যে।' কিছুদিন থেকে একটি ছেলের দিকে সোহিনী দৃষ্টিপাত করছিল। ছেলেটি পছন্দসই বটে। তার নাম রেবতী ভট্টাচার্য। এরই মধ্যে সায়ান্সের ডাক্তার পদবীতে চড়ে বসেছে। ওর দুটো-একটা লেখার যাচাই হয়ে গেছে বিদেশে।

লোকের সঙ্গে মেলামেশা করবার কলাকৌশল সোহিনীর ভালো করেই জানা আছে। মন্মথ চৌধুরী রেবতীর প্রথম দিককার অধ্যাপক। তাঁকে নিলে বশ করে। কিছুদিন চায়ের সঙ্গে রুটিটোস্ট, অমলেট, কখনো বা ইলিশমাছের ডিমের বড়া খাইয়ে কথাটা পাড়লে। বললে, 'আপনি হয়তো ভাবছেন আমি আপনাকে বারে বারে চা খেতে ডাকি কেন।'
'মিসেস মল্লিক, আমি তোমাকে নিশ্চয় বলতে পারি, সেটা আমার দুর্ভাবনার বিষয় নয়।'
সোহিনী বললে,'লোকে ভাবে, আমরা বন্ধুত্ব করে থাকি স্বার্থের গরজে।'
'দেখো মিসেস মল্লিক, আমার মত হচ্ছে এই-- গরজটা যারই হোক, বন্ধুত্বটাই তো লাভ। আর এই বা কম কথা কী, আমার মতো অধ্যাপককে দিয়েও কারো স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে। এ জাতটার বুদ্ধি কেতাবের বাইরে হাওয়া খেতে পায় না ব'লে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমার কথা শুনে তোমার হাসি পাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। দেখো, যদিও আমি মাস্টারি করি তবু ঠাট্টা করতেও পারি। দ্বিতীয়বার চা খেতে ডাকবার পূর্বে এটা জেনে রাখা ভালো।'
'জেনে রাখলুম, বাঁচলুম। অনেক অধ্যাপক দেখেছি, তাঁদের মুখ থেকে হাসি বের করতে ডাক্তার ডাকতে হয়।'
'বাহবা, আমারই দলের লোক দেখছি তুমি। তা হলে এবার আসল কথাটা পাড়া হোক।'
'জানেন বোধ হয়, জীবনে আমার স্বামীর ল্যাবরেটরিই ছিল একমাত্র আনন্দ। আমার ছেলে নেই, ঐ ল্যাবরেটরিতে বসিয়ে দেব বলে ছেলে খুঁজছি। কানে এসেছে রেবতী ভট্টাচার্যের কথা।'
অধ্যাপক বললেন। 'যোগ্য ছেলেই বটে। তার যে লাইনের বিদ্যে সেটাকে শেষ পর্যন্ত চালান করতে মালমসলা কম লাগবে না।'
সোহিনী বললে, 'আমার রাশ-করা টাকায় ছাতা পড়ে যাচ্ছে। আমার বয়সের বিধবা মেয়েরা ঠাকুরদেবতার দালালদের দালালি দিয়ে পরকালের দরজা ফাঁক করে নিতে চায়। আপনি শুনে হয়তো রাগ করবে, আমি ও-সব কিছুই বিশ্বাস করি নে।'
চৌধুরী দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, 'তুমি তবে কী মান।
'মানুষের মতো মানুষ যদি পাই, তবে তার সব পাওনা শোধ করে দিতে চাই যতদূর আমার সাধ্য আছে। এই আমার ধর্মকর্ম।'
চৌধুরী বললেন, 'হুররে। শিলা ভাসে জলে। মেয়েদের মধ্যেও দৈবাৎ কোথাও কোথাও বুদ্ধির প্রমাণ মেলে দেখছি। আমার একটি বি.এস্‌সি. বোকা আছে, সেদিন হঠাৎ দেখি, গুরুর পা ছুঁয়ে সে উলটো ডিগবাজি খেলতে লেগেছে, মগজ থেকে বুদ্ধি যাচ্ছে উড়ে ফাটা শিমূলের তুলোর মতো। তা তোমার বাড়িতেই ওকে ল্যাবরেটরিতে বসিয়ে দিতে চাও? তফাতে আর কোথাও হলে হয় না?'
'চৌধুরীমশায়, আপনি ভুল করবেন না, আমি মেয়েমানুষ। এইখানেই এই ল্যাবরেটরিতেই হয়েছে আমার স্বামীর সাধনা। তাঁর ঐ বেদীর তলায় কোনো-একজন যোগ্য লোককে বাতি জ্বালিয়ে রাখবার জন্যে যদি বসিয়ে দিতে পারি, তা হলে যেখানে থাকুন তাঁর মন খুশি হবে।'
চৌধুরী বললেন, 'বাই জোভ, এতক্ষণে মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুনতে খারাপ লাগল না। একটা কথা জেনে রেখো, রেবতীকে যদি শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সাহায্য করতে চাও তা হলে লাখটাকারও লাইন পেরিয়ে যাবে।'
'গেলেও আমার খুদকুঁড়ো কিছু বাকি থাকবে।'
'কিন্তু পরলোকে যাঁকে খুশি করতে চাও তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে না তো?শুনেছি তাঁরা ইচ্ছা করলে ঘাড়ে চড়ে লাফালাফি করতে পারেন।' 'আপনি খবরের কাগজে পড়েন তো। মানুষ মারা গেলেই তার গুণাবলী প্যারাগ্রাফে প্যারাগ্রাফে ছাপিয়ে পড়তে থাকে। সেই মৃত মানুষের বদান্যতার 'পরে ভরসা করলে তো দোষ নেই। টাকা যে মানুষ জমিয়েছে অনেক পাপ জমিয়েছে সে তার সঙ্গে, আমরা কী করতে আছি যদি থলি ঝেড়ে স্বামীর পাপ হালকা করতে না পারি। যাক গে টাকা, আমার টাকায় দরকার নেই।'
অধ্যাপক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, 'কী আর বলব তোমাকে। খনি থেকে সোনা ওঠে, সে খাঁটি সোনা, যদিও তাতে মিশোল থাকে অনেক-কিছু। তুমি সেই ছদ্মবেশী সোনার ঢেলা। চিনেছি তোমাকে। এখন কী করতে হবে বলো।'
'ঐ ছেলেটিকে রাজি করিয়ে দিন।'
'চেষ্টা করব, কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়। আর কেউ হলে তোমার দান লাফিয়ে নিত।'
'কোথায় বাধছে বলুন।
'শিশুকাল থেকে একটি মেয়ে-গ্রহ ওর কুষ্টি দখল করে এসেছে। রাস্তা আগলে রয়েছে অটল অবুদ্ধি।'
'বলেন কী। পুরুষমানুষ--'
'দেখো মিসেস মল্লিক, রাগ করবে কাকে নিয়ে। জানো মেট্রিয়ার্কাল সমাজ কাকে বলে। যে সমাজে মেয়েরাই হচ্ছে পুরুষেরা সেরা। এক সময়ে সেই দ্রাবিড়ী সমাজের ঢেউ বাংলাদেশে খেলত।'
সোহিনী বললে, 'সে সুদিন তো গেছে। তলায় তলায় ঢেউ খেলে হয়তো, ঘুলিয়ে দেয় বুদ্ধিসুদ্ধি, কিন্তু হাল যে একলা পুরুষের হাতে। কানে মন্ত্র দেন তাঁরাই, আর জোরে দেন কানমলা। কান ছিঁড়ে যাবার জো হয়।'
'আহা হা, কথা কইতে জান তুমি। তোমার মতো মেয়েদের যুগ যদি আসে তা হলে মেট্রিয়ার্কাল সমাজে ধোবার বাড়ির ফর্দ রাখি মেয়েদের শাড়ির, আর আমাদের কলেজের প্রিন্সিপল্‌কে পাঠিয়ে দিই ঢেঁকি কুটতে। মনোবিজ্ঞান বলে, বাংলাদেশে মেট্রিয়ার্কি বাইরে নেই, আছে নাড়িতে। মা মা শব্দে হাম্বাধ্বনি আর-কোনো দেশের পুরুষমহলে শুনেছ কি। তোমাকে খবর দিচ্ছি, রেবতীর বুদ্ধির ডগার উপরে চড়ে বসে আছে একটি রীতিমতো মেয়ে।'
'কাউকে ভালোবাসে নাকি।'
'আহা, সেটা হলে তো বুঝতুম, ওর শিরায় প্রাণ করছে ধুক্‌ধুক্‌। যুবতীর হাতেবুদ্ধি খোয়াবার বায়না নিয়েই তো এসেছে, এই তো সেই বয়েস। তা না হয়ে এই কাঁচা বয়সে ও যে এক মালাজপকারিণীর হাতে মালার গুটি বনে গেছে। ওকে বাঁচাবে কিসে-- না যৌবন, না বুদ্ধি, না বিজ্ঞান।' 'আচ্ছা একদিন ওঁকে এখানে চা খেতে ডাকতে পারি কি। আমাদের মতো অশুচির ঘরে খাবেন তো?'
'অশুচি! না খায় তো ওকে আছড়ে আছড়ে এমনি শুচি করে নেব যে বামনাইয়ের দাগ থাকবে না ওর মজ্জায়। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার নাকি একটি সুন্দরী মেয়ে আছে?'
'আছে। পোড়াকপালী সুন্দরীও বটে। তা কী করব বলুন।'
'না না, আমাকে ভুল কোরো না। আমার কথা যদি বল, সুন্দরী মেয়ে আমি পছন্দই করি। ওটা আমার একটা রোগ বললেই হয়। কিন্তু ওর আত্মীয়েরা বেরসিক, ভয় পেয়ে যাবে।'
'ভয় নেই, আমি নিজের জাতেই মেয়ের বিয়ে দেব ঠিক করেছি।'
এটা একেবারে বানানো কথা।
'তুমি নিজে তো বেজাতে বিয়ে করেছ।'
'নাকাল হয়েছি কম নয়। বিষয়ের দখল নিয়ে মামলা করতে হয়েছে বিস্তর। যে করে জিতেছি সেটা বলবার কথা নয়।'
'শুনেছি কিছু কিছু। বিপক্ষ পক্ষের আর্টিকেল্‌ড্‌ ক্লার্ক্‌কে নিয়ে তোমার নামে গুজব রটেছিল। মকদ্দমায় জিতে তুমি তো সরে পড়লে, সে লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যায় আর কি!'
'এত যুগ ধরে মেয়েমানুষ টিঁকে আছে কী ক'রে। ছল করার কম কৌশল লাগে না, লড়াইয়ের তাগবাগের সমানই সে, তবে কিনা তাতে মধুও কিছু খরচ করতে হয়। এ হল নারীর স্বভাবদত্ত লড়াইয়ের রীতি।'
'ঐ দেখো, আবার তুমি আমাকে ভুল করছ। আমরা বিজ্ঞানী, আমরা বিচারক নই, স্বভাবের খেলা আমরা নিষ্কাম ভাবে দেখে যাই। সে খেলায় যা ফল হবার তা ফলতে থাকে। তোমার বেলায় ফলটা বেশ হিসেবমতোই ফলেছিল, বলেছিলুম, ধন্য মেয়ে তুমি। এ কথাটাও ভেবেছি, আমি যে তখন প্রোফেসর ছিলুম, আর্টিকেল্‌ড্‌ ক্লার্ক ছিলুম না, সেটা আমার বাঁচোয়া। মার্করি সূর্যের কাছ থেকে যতটুকু দূরে আছে ততটুকু দূরে থেকেই বেঁচে গেল। ওটা গণিতের হিসাবের কথা, ওতে ভালো নেই মন্দ নেই। এ-সব কথা বোধ হয় তুমি বুঝতে শিখেছ।'
'তা শিখেছি। গ্রহগুলো টান মেনে চলে আবার টান এড়িয়ে চলে-- এটা একটা শিখে নেবার তত্ত্ব বৈকি।'
'আর-একটা কথা কবুল করছি। এইমাত্র তোমার সঙ্গে কথা কইতে কইতে একটা হিসেব মনে মনে কষছিলুম, সেও অঙ্কের হিসেব। ভেবে দেখো, বয়সটা যদি অন্তত দশটা বছর কম হত তা হলে খামকা আজ একটা বিপদ ঘটত। কোলিশন ঐটুকু পাশ কাটিয়ে গেল আর কি! তবু বাষ্পের জোয়ার উঠছে বুকের মধ্যে। ভেবে দেখো, সৃষ্টিটা আগাগোড়াই কেবল অঙ্ককষার খেলা।'
এই ব'লে চৌধুরী দুই হাঁটু চাপড়িয়ে হাহা করে হেসে উঠলেন। একটা কথা তাঁর হুঁশ ছিল না যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করবার আগে সোহিনী দুঘন্টা ধরে রঙে চঙে এমন করে বয়স বদল করেছে যে সৃষ্টিকর্তাকে আগাগোড়াই দিয়েছে ঠকিয়ে।

পরের দিন অধ্যাপক এসে দেখলেন সোহিনী রোঁয়া-ওঠা হাড়-বের করা একটা কুকুরকে স্নান করিয়ে তোয়ালে দিয়ে তার গা মুছিয়ে দিচ্ছে। চৌধুরী জিগ্‌গেসা করলেন, 'এই অপয়মন্তটাকে এত সম্মান কেন।'
'ওকে বাঁচিয়েছি ব'লে। পা ভেঙেছিল মোটরের তলায় পড়ে, আমি সারিয়ে তুলেছি ব্যাণ্ডেজ বেঁধে। এখন ওর প্রাণটার মধ্যে আমারও শেয়ার আছে।'
'রোজ রোজ ঐ অলুক্ষুনের চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে যাবে না?'
'চেহারা দেখবার জন্যে ওকে তো রাখি নি। মরতে মরতে ওই যে ও সেরে উঠছে, এটা দেখতে আমার ভালো লাগে। ঐ প্রাণীর বেঁচে থাকবার দরকারটা যখন দিনে দিনে মিটিয়ে দিই, তখন ধর্মকর্ম করতে ছাগলছানার গলায় দড়ি বেঁধে আমাকে কালীতলায় দৌড়তে হয় না। তোমাদের বায়োলজির ল্যাবরেটরির কানাখোঁড়া কুকুর-খরগোশগুলোর জন্যে আমি একটা হাসপাতাল বানাব স্থির করেছি।'
'মিসেস মল্লিক, তোমাকে যতই দেখছি তাক লাগছে।'
'আরো বেশি দেখলে ওটার উপশম হবে। রেবতীবাবুর খবর দেবেন বলেছিলেন, সেটা আরম্ভ করে দিন।'
'আমার সঙ্গে দূর সম্পর্কে ওদের যোগ আছে। তাই ওদের ঘরের খবর জানি। রেবতীকে জন্ম দিয়েই ওর মা যান মারা। বরাবর ও পিসির হাতে মানুষ। ওর পিসির আচারনিষ্ঠা একেবারে নিরেট। এতটুকু খুঁত নিয়ে ওঁর খুঁতখুঁতুনি সংসারকে অতিষ্ঠ করে তুলত। তাঁকে ভয় না করত এমন লোক ছিল না পরিবারে। ওঁর হাতে রেবতীর পৌরুষ গেল ছাতু হয়ে। স্কুল থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে পঁচিশ মিনিট লাগত তার জবাবদিহি করতে।'
সেহিনী বললে, 'আমি তো জানি পুরুষরা করবে শাসন, মেয়েরা দেবে আদর, তবেই ওজন ঠিক থাকে।'
অধ্যাপক বললেন, 'ওজন ঠিক রেখে চলা মরালগামিনীদের ধাতে নেই। ওরা এদিকে ঝুঁকবে ওদিকে ঝুঁকবে। কিছু মনে কোরো না মিসেস মল্লিক, ওদের মধ্যেও দৈবাৎ মেলে যারা খাড়া রাখে মাথা, চলে সোজা চালে। যেমন--'
'আর বলতে হবে না। কিন্তু আমার মধ্যেও শিকড়ের দিকে মেয়েমানুষ যথেষ্ট আছে। কী ঝোঁকে পেয়েছে দেখছেন না! ছেলে-ধরা ঝোঁক। নইলে আপনাকে বিরক্ত করতেম কি।'
'দেখো, বার বার ঐ কথাটা বোলো না। জেনে রেখো আজ ক্লাসের জন্যে তৈরি না হয়েই চলে এসেছি। কর্তব্যের গাফেলি এতই ভালো লাগছে।' 'বোধ হয় মেয়ে-জাতটার 'পরেই আপনার বিশেষ একটু কৃপা আছে।'
'একটুও অসম্ভব নয়। কিন্তু তার মধ্যেও তো ইতরবিশেষ আছে। যা হোক, সে কথাটা পরে হবে।'
সোহিনী হেসে বললে, 'পরে না হলেও চলবে। আপাতত যে কথাটা উঠেছে শেষ করে দিন। রেবতীবাবুর এত উন্নতি হল কী করে।'
'যা হতে পারত তার তুলনায় কিছুই হয় নি। একটা রিসর্চের কাজে ওর বিশেষ দরকার হয়েছিল উঁচু পাহাড়ে যাবার। ঠিক করেছিল যাবে বদরিকাশ্রমে। আরে সর্বনাশ! পিসিরও ছিল এক পিসি, সে বুড়ি মরবে তো মরুক ঐ বদরিকারই রাস্তায়। পিসি বললে, 'আমি যতদিন বেঁচে আছি, পাহাড়পর্বত চলবে না।' কাজেই তখন থেকে একমনে যা কামনা করছি সে মুখ ফুটে বলবার নয়। থাক্‌ সে কথা।'
'কিন্তু শুধু পিসিমাদের দোষ দিলে চলবে কেন। মায়ের দুলাল ভাইপোদের হাড় বুঝি কোনো কালে পাকবে না।'
'সে তো পূর্বেই বলেছি। মেট্রিয়ার্কি রক্তের মধ্যে হাম্বাধ্বনি জাগিয়ে তোলে, হতবুদ্ধি হয়ে যায় বৎসরা। আফসোসের কথা কী আর বলব। এ তো হল নম্বর ওয়ান। তার পরে রেবতী যখন সরকারের বৃত্তি নিয়ে কেম্ব্রিজে যাবে স্থির হল, আবার এসে পড়ল সেই পিসিমা হাউ হাউ শব্দে। তার বিশ্বাস, ও চলেছে মেমসাহেব বিয়ে করতে। আমি বললুম, নাহয় করল বিয়ে। সর্বনাশ, কথাটা আন্দাজে ছিল, এবার যেন পাকা দেখা হয়ে গেল। পিসি বললে, 'ছেলে যদি বিলেতে যায় তা হলেগলায় দড়ি দিয়ে মরব।' কোন্‌ দেবতার দোহাই পাড়লে পাকানো হবে দড়িটা নাস্তিক আমি জানি নে, তাই দড়িটা বাজারে মিলল না। রেবতীকে খুব খানিকটা গাল দিলুম, বললুম স্টুপিড, বললুম ডান্স, বললুম ইম্‌বেসীল। ব্যস, ঐখানেই খতম। রেবু এখন ভারতীয় ঘানিতে ফোঁটা ফোঁটা তেল বের করছেন।'
সোহিনী অস্থির হয়ে বলে উঠল, 'দেয়ালে মাথা ঠুকে মরতে ইচ্ছে করছে। একটা মেয়ে রেবতীকে তলিয়ে দিয়েছে, আর-একটা মেয়ে তাকে টেনে তুলবে ডাঙায়, এই আমার পণ রইল।'
'পষ্ট কথা বলি ম্যাডাম। জানোয়ারগুলোকে শিঙে ধরে তলিয়ে দেবার হাত তোমার পাকা-- লেজে ধরে তাদের উপরে তোলবার হাত তেমন দুরস্ত হয় নি। তা এখন থেকে অভ্যাসটা শুরু হোক। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সায়ান্সে এত উৎসাহ তোমার এল কোথা থেকে।'
'সকল রকম সায়ান্সেই সারা জীবন আমার স্বামীর মন ছিল মেতে। তাঁর নেশা ছিল বর্মা চুরুট আর ল্যাবরেটরি। আমাকে চুরুট ধরিয়ে প্রায় বর্মিজ মেয়ে বানিয়ে তুলেছিলেন। ছেড়ে দিলুম, দেখলুম পুরুষদের চোখে খটকা লাগে। তাঁর আর-এক নেশা আমার উপর দিয়ে জমিয়েছিলেন। পুরুষরা মেয়েদের মজায় বোকা বানিয়ে, উনি আমাকে মজিয়েছিলেন বিদ্যে দিয়ে দিনরাত। দেখুন চৌধুরীমশায়, স্বামীর দুর্বলতা স্ত্রীর কাছে ঢাকা থাকে না, কিন্তু আমি ওঁর মধ্যে কোনোখানে খাদ দেখতে পাই নি। কাছে থেকে যখন দেখতুম, দেখেছি উনি বড়ো; আজ দূরে থেকে দেখছি, দেখি উনি আরো বড়ো।'
চৌধুরী জিগ্‌গেসা করলেন, 'কোনখানে সব চেয়ে তাঁকে বড়ো ঠেকছে।'
'বলব? উনি বিদ্বান বলে নয়। বিদ্যার 'পরে ওঁর নিষ্কাম ভক্তি ছিল ব'লে। উনি একটা পুজোর আলো পুজোর হাওয়ার মধ্যে ছিলেন। আমরা মেয়েরা দেখবার-ছোঁবার মতো জিনিস না পেলে পুজো করবার পথ পাই নে। তাঁর এই ল্যাবরেটরি আমার পুজোর দেবতা হয়েছে। ইচ্ছে করে এখানে মাঝে মাঝে ধূপধুনো জ্বালিয়ে শাঁখঘন্টা বাজাই। ভয় করি আমার স্বামীর ঘৃণাকে। তাঁর দৈনিক যখন পুজো ছিল, এই-সব যন্ত্রতন্ত্র ঘিরে জমত কলেজের ছাত্রেরা, শিক্ষা নিত তাঁর কাছ থেকে, আর আমিও বসে যেতুম।
'ছেলেগুলো সায়ান্সে মন দিতে পারত কি।'
'যারা পারত তাদেরই বাছাই হয়ে যেত। এমন-সব ছেলে দেখেছি যারা সত্যকার বৈরাগী। আবার দেখেছি কেউ কেউ নোট নেবার ছলে একেবারে পাশের ঠিকানায় চিঠি লিখে সাহিত্যচর্চা করত।'
'কেমন লাগত?'
'সত্যি কথা বলব? খারাপ লাগত না। স্বামী চলে যেতেন কাজে, ভাবুকদের মন আশেপাশে ঘুর ঘুর করত।'
'কিছু মনে কোরো না, আমি সাইকলজি স্টাডি করে থাকি। জিগ্‌গেসা করি, ওরা কিছু ফল পেত কি।'
'বলতে ইচ্ছে করে না, নোংরা আমি। দু-চার জনের সঙ্গে জানাশোনা হয়েছে যাদের কথা মনে পড়লে আজও মনের মধ্যে মুচড়িয়ে ধরে।'
'দু-চার জন?'
'মন যে লোভী, মাংসমজ্জার নীচে লোভের চাপা আগুন সে লুকিয়ে রেখে দেয়, খোঁচা পেলে জ্বলে ওঠে। আমি তো গোড়াতেই নাম ডুবিয়েছি, সত্যি কথা বলতে আমার বাধে না। আজন্ম তপস্বিনী নই আমরা। ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মেয়েদের। দ্রৌপদীকুন্তীদের সেজে বসতে হয় সীতাসাবিত্রী। একটা কথা বলি আপনাকে চৌধুরীমশায়, মনে রাখবেন, ছেলেবেলা থেকে ভালোমন্দ-বোধ আমার স্পষ্ট ছিল না। কোনো গুরু আমায় তা শিক্ষা দেন নি। তাই মন্দের মাঝে আমি ঝাঁপ দিয়েছি সহজে, পারও হয়ে গেছি সহজে। গায়ে আমার দাগ লেগেছে কিন্তু মনে ছাপ লাগে নি। কিছু আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারে নি। যাই হোক, তিনি যাবার পথে তাঁর চিতার আগুনে আমার আসক্তিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, জমা পাপ একে একে জ্বলে যাচ্ছে। এই ল্যাবরেটরিতেই জ্বলছে সেই হোমের আগুন।'
'ব্র্যাভো, সত্যি কথা বলতে কী সাহস তোমার।'
'সত্যি কথা বলিয়ে নেবার লোক থাকলে বলা সহজ হয়। আপনি যে খুব সহজ, খুব সত্যি।'
'দেখো, ঐ যে চিঠি লিখিয়ে ছেলেগুলো তোমার প্রসাদ পেয়েছিল, তারা কি এখনো আনাগোনা করে।'
'সেই করেই তো তারা মুছে দিয়েছে আমার মনের ময়লা। দেখলুম, জুটছে তারা আমার চেকবইয়ের দিকে লক্ষ করে। ভেবেছিল মেয়েমানুষের মোহ মরতে চায় না, ভালোবাসার সিঁধের গর্ত দিয়ে পৌঁছবে তাদের হাত আমার টাকার সিন্দুকে। এত রস আমার নেই,তারা তা জানত না। আমার শুকনো পাঞ্জাবি মন। আমি সমাজের আইনকানুন ভাসিয়ে দিতে পারি দেহের টানে প'ড়ে, কিন্তু প্রাণ গেলেও বেইমানি করতে পারব না। আমার ল্যাবরেটরির এক পয়সাও তারা খসাতে পারে নি। আমার প্রাণ শক্ত পাথর হয়ে চেপে আছে আমার দেবতার ভাণ্ডারের দ্বার। ওদের সাধ্য নেই সে পাথর গলাবে। আমাকে যিনি বেছে এনেছিলেন তিনি ভুল করেন নি।'
'তাঁকে আমি প্রণাম করি, আর পাই যদি সেই ছেলেগুলোর কান মলে দিই।'
বিদায় নেবার আগে অধ্যাপক একবার ল্যাবরেটরিটা ঘুরে এলেন সোহিনীকে সঙ্গে নিয়ে। বললেন, 'এখানেই মেয়েলিবুদ্ধির চোলাই হয়ে গেছে, অপদেবতার গাদ গেছে নেমে, বেরিয়ে এসেছে খাঁটি স্পিরিট।'
সোহিনী বললে, 'যা বলুন, মন থেকে ভয় যায় না। মেয়েলিবুদ্ধি বিধাতার আদি সৃষ্টি। যখন বয়স অল্প থাকে মনের জোর থাকে, তখন সে লুকিয়ে থাকে ঝোপেঝাপে, যেই রক্ত আসে ঠাণ্ডা হয়ে, বেরিয়ে আসেন সনাতনী পিসিমা। তার আগেই আমার মরবার ইচ্ছে রইল।'
অধ্যাপক বললেন, 'ভয় নেই তোমার, আমি বলছি তুমি সজ্ঞানে মরবে।'

সাদা শাড়ি পরে মাথায় কাঁচাপাকা চুলে পাউডার মেখে সোহিনী মুখের উপর একটি শুচি সাত্ত্বিক আভা মেজে তুললে। মেয়েকে নিয়ে মোটরলঞ্চে করে উপস্থিত হল বোটানিকালে। তাকে পরিয়েছে নীলচে সবুজ বেনারসী শাড়ি, ভিতর থেকে দেখা যায় বসন্তী রঙের কাঁচুলি। কপালে তার কুঙ্কুমের ফোঁটা, সূক্ষ্ণ একটু কাজলের রেখা চোখে, কাঁধের কাছে ঝুলেপড়া গুচ্ছকরা খোঁপা, পায়ে কালো চামড়ার 'পরে লাল মখমলের কাজ-করা স্যাণ্ডেল।
যে আকাশনিম বীথিকার তলায় রেবতী রবিবার কাটায় আগে থাকতে সংবাদ নিয়ে সোহিনী সেইখানেই এসে তাকে ধরলে। প্রণাম করলে একেবারে তার পায়ে মাথা রেখে। বিষয় ব্যস্ত হয়ে উঠল রেবতী।
সোহিনী বললে, 'কিছু মনে কোরো না বাবা, তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে, আমি ছত্রির মেয়ে। চৌধুরীমশায়ের কাছে আমার কথা শুনে থাকবে।'
'শুনেছি। কিন্তু এখানে আপনাকে বসাব কোথায়।'
'এই-যে রয়েছে সবুজ তাজা ঘাস, এমন আসন কোথায় পাওয়া যায়। ভাবছ বোধ হয়, এখানে আমি কী করতে এসেছি। এসেছি আমার ব্রত উদ্‌যাপন করতে। তোমার মতো ব্রাহ্মণ তো খুঁজে পাব না।'
রেবতী আশ্চর্য হয়ে বললে, 'আমার মতো ব্রাহ্মণ?'
'তা না তো কী। আমার গুরু বলেছেন, এখনকার কালের সবসেরা যে বিদ্যা তাতেই যাঁর দখল তিনিই সেরা ব্রাহ্মণ।'
রেবতী অপ্রস্তুত হয়ে বললে, 'আমার বাবা করতেন যজনযাজন, আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি নে।'
'বল কী, তুমি যে-মন্ত্র শিখেছ সেই মন্ত্রে জগৎ হয়েছে মানুষের বশ। তুমি ভাবছ মেয়েমানুষের মুখে এ-সব কথা এল কোথা থেকে। পেয়েছি পুরুষের মতো পুরুষের মুখ থেকে। তিনি আমার স্বামী। যেখানে তাঁর সাধনার পীঠস্থান ছিল, কথা দাও বাবা, সেখানে তোমাকে যেতে হবে।' 'কাল সকালে আমার ছুটি আছে, যাব।'
'তোমার দেখছি গাছপালার শখ। বড়ো আনন্দ হল। গাছপালার খোঁজে আমার স্বামী গিয়েছিলেন বর্মায়, আমি তাঁর সঙ্গ ছাড়ি নি।'
সঙ্গ ছাড়ে নি কিন্তু সায়ান্সের চর্চায় নয়। নিজের ভিতর থেকে যে গাদ উঠত ফুটে, স্বামীর চরিত্রের মধ্যেও সেটা অনুমান না করে থাকতে পারত না। সন্দেহের সংস্কার ছিল ওর আঁতে আঁতে। একসময়ে নন্দকিশোরের যখন গুরুতর পীড়া হয়েছিল, তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, 'মরবার একমাত্র আরাম এই যে, সেখান থেকে তুমি আমাকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।'
সোহিনী বললে, 'সঙ্গে যেতে পারি তো।'
নন্দকিশোর হেসে বললেন, 'সর্বনাশ!'
সোহিনী রেবতীকে বললে, 'বর্মা থেকে আসবার সময় এনেছিলুম এক গাছের চারা। বর্মিজরা তাকে বলে ক্কোষাইটানিয়েঙ্গ্‌। চমৎকার ফুলের শোভা-- কিন্তু কিছুতেই বাঁচাতে পারলুম না।'
আজই সকালে স্বামীর লাইব্রেরি ঘেঁটে এ নাম সোহিনী প্রথম বের করেছে। গাছটা চোখেও দেখে নি। বিদ্যার জাল ফেলে বিদ্বানকে টানতে চায়। অবাক হল রেবতী। জিগ্‌গেসা করলে, 'এর লাটিন নামটা কি জানেন।'
সোহিনী অনায়াসে বলে দিলে, 'তাকে বলে মিলেটিয়া।'
বললে, 'আমার স্বামী সহজে কিছু মানতেন না, তবু তাঁর একটা অন্ধবিশ্বাস ছিল ফলে ফুলে প্রকৃতির মধ্যে যা-কিছু আছে সুন্দর, মেয়েরা বিশেষ অবস্থায় তার দিকে একান্ত করে যদি মন রাখে তা হলে সন্তানরা সুন্দর হয়ে জন্মাবেই। এ কথা তুমি বিশ্বাস কর কি।'
বলা বাহুল্য এটা নন্দকিশোরের মত নয়।
রেবতী মাথা চুলকিয়ে বললে, 'যথোচিত প্রমাণ তো এখনো জড়ো হয় নি।'
সোহিনী বললে, 'অন্তত একটা প্রমাণ পেয়েছি আমার আপন ঘরেই। আমার মেয়ে এমন আশ্চর্য রূপ পেল কোথা থেকে। বসন্তের নানা ফুলের যেন-- থাক্‌, নিজের চোখে দেখলেই বুঝতে পারবে।'
দেখবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠল রেবতী। নাট্যের কোনো সরঞ্জাম বাকি ছিল না। সোহিনী তার রাঁধুনী বামুনকে সাজিয়ে এনেছে পূজারী বামুনের বেশে। পরনে চেলি, কপালে ফোঁটাতিলক,টিকিতে ফুল বাঁধা, বেলের আঠায় মাজা মোটা পইতে গলায়। তাকে ডেকে বললে, 'ঠাকুর, সময় তো হল, নীলুকে এবার ডেকে নিয়ে এসো।'
নীলাকে তার মা বসিয়ে রেখেছিল স্টীমলঞ্চে। ঠিক ছিল ডালি হাতে সে উঠে আসবে, বেশ খানিকক্ষন তাকে দেখা যাবে সকালবেলায় ছায়ায়-আলোয়।
ইতিমধ্যে রেবতীকে সোহিনী তন্ন তন্ন করে দেখে নিতে লাগল। রঙ মসৃণ শ্যামবর্ণ, একটু হলদের আভা আছে। কপাল চওড়া, চুলগুলো আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে উপরে তোলা। চোখ বড়ো নয় কিন্তু তাতে দৃষ্টিশক্তির স্বচ্ছ আলো জ্বল্‌জ্বল্‌ করছে, মুখের মধ্যে সেইটেই সকলের চেয়ে চোখে পড়ে। নীচে মুখের বেড়টা মেয়েলি ধাঁচের মোলায়েম। রেবতীর সম্বন্ধে ও যত খবর জোগাড় করেচে তার মধ্যে ও বিশেষ লক্ষ্য করেছে একটা কথা। ছেলেবেলাকার বন্ধুদের ওর উপরে ছিল কান্নাকাটি-জড়ানো সেণ্টিমেন্টাল ভালোবাসা। ওর মুখে যে একটা দুর্বল মাধুর্য ছিল, তাতে পুরুষ বালকদের মনে মোহ আনতে পারত।
সোহিনীর মনে খটকা লাগল। ওর বিশ্বাস, মেয়েদের মনকে নোঙরের মতো শক্ত করে আঁকড়ে ধরার জন্যে পুরুষের ভালো দেখতে হওয়ার দরকারই করে না। বুদ্ধিবিদ্যেটাও গৌণ। আসল দরকার পৌরুষের ম্যাগনেটিজ্‌ম। সেটা তার স্নায়ুর পেশীর ভিতরকার বেতার-বার্তার মতো। প্রকাশ পেতে থাকে কামনার অকথিত স্পর্ধারূপে।
মনে পড়ল, নিজের প্রথম বয়সের রসোন্মত্ততার ইতিহাস। ও যাকে টেনেছিল কিংবা যে টেনেছিল ওকে, তার না ছিল রূপ, না ছিল বিদ্যা, না ছিল বংশগৌরব। কিন্তু কী একটা অদৃশ্য তাপের বিকিরণ ছিল যার অলক্ষ্য সংস্পর্শে সমস্ত দেহ মন দিয়ে ও তাকে অত্যন্ত করে অনুভব করেছিল পুরুষমানুষ ব'লে; নীলার জীবনে কখন একসময়ে সেই অনিবার্য আলোড়নের আরম্ভ হবে এই ভাবনা তাকে স্থির থাকতে দিত না। যৌবনের শেষ দশাই সকলের চেয়ে বিপদের দশা, সেই সময়টাতে সোহিনীকে অনেকখানি ভুলিয়ে রেখেছিল নিরবকাশ জ্ঞানের চর্চায়। কিন্তু দৈবাৎ সোহিনীর মনের জমি ছিল স্বভাবত উর্বরা। কিন্তু যে জ্ঞান নৈর্ব্যক্তিক, সব মেয়ের তার প্রতিটান থাকে না। নীলার মনে আলো পৌঁছয় না।
নদীর ঘাট থেকে আস্তে আস্তে দেখা দিল নীলা। রোদ্‌দুর পড়েছে তার কপালে তার চুলে, বেনারসী শাড়ির উপরে জরির রশ্মি ঝল্‌মল্‌ করে উঠছে। রেবতীর দৃষ্টি একমুহূর্তের মধ্যে ওকে ব্যাপ্ত করে দেখে নিলে। চোখ নামিয়ে নিল পরক্ষণেই। ছেলেবেলা থেকে তার এই শিক্ষা। যে সুন্দরী মেয়ে মহামায়ার মনোহারিণী লীলা, তাকে আড়াল করে রেখেছে পিসির তর্জনী। তাই যখন সুযোগ ঘটে তখন দৃষ্টির অমৃত ওকে তাড়াতাড়ি এক চুমুকে গিলতে হয়।
মনে মনে রেবতীকে ধিক্কার দিয়ে সোহিনী বললে, 'দেখো দেখো, একবার চেয়ে দেখো।'
রেবতী চমকে উঠে চোখ তুলে চাইলে।
সোহিনী বললে, 'দেখো তো ডক্টর অব সায়ান্স, ওর শাড়ির রঙের সঙ্গে পাতার রঙের কী চমৎকার মিল হয়েছে।'
রেবতী সসংকোচে বললে, 'চমৎকার!'
সোহিনী মনে মনে বললে, 'নাঃ আর পারা গেল না!' আবার বললে, 'ভিতরে বসন্তী রঙ উঁকি মারছে, উপরে সব্‌জে নীল। কোন্‌ ফুলের সঙ্গে মেলে বলো দেখি।'
উৎসাহ পেয়ে রেবতী ভালো করেই দেখলে। বললে, 'একটা ফুল মনে পড়ছে কিন্তু উপরের আবরণটা ঠিক নীল নয়, ব্রাউন।'
'কোন্‌ ফুল বলো তো।'
রেবতী বললে, 'মেলিনা।'
'ও বুঝেছি। তার পাঁচটি পাপড়ি, একটি উজ্জ্বল হলদে, বাকি চারটে শ্যামবর্ণ।'
রেবতী আশ্চর্য হয়ে গেল। বললে, 'এত করে ফুলের পরিচয় জানলেন কী করে।'
সোহিনী হেসে বললে, 'জানা উচিত হয় নি বাবা। পুজোর সাজির বাইরের ফুল আমাদের কাছে পরপুরুষ বললেই হয়।'
ডালি হাতে এল ধীরে ধীরে নীলা। মা বললে, 'জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি কেন। পা ছুঁয়ে প্রণাম কর।'
'থাক্‌ থাক্‌' ব'লে রেবতী অস্থির হয়ে উঠল। রেবতী আসন করে বসেছিল, পা খুঁজে বের করতে নীলাকে একটু হাতড়াতে হল। শিউরে উঠল রেবতীর সমস্ত শরীর। ডালিতে ছিল দুর্লভ-জাতীয় অর্কিডের মঞ্জরি, রুপোর থালায় ছিল বাদামের তক্তি, পেস্তার বরফি, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, মালাইয়ের বরফি, চৌকো করে কাটা কাটা ভাপা দই।
বললে, 'এ-সমস্তই তৈরি নীলার নিজের হাতে।'
সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। এ-সব কাজে নীলার না ছিল হাত, না ছিল মন।
সোহিনী বললে, 'একটু মুখে দিতে হয় বাবা, ঘরে তৈরি তোমারই উদ্দেশে।
ফরমাশে তৈরি বড়োবাজারের এক চেনা দোকানে।
রেবতী হাত জোড় করে বললে, 'এ সময়ে খাওয়া আমার অভ্যাস নয়। বরং অনুমতি করেন যদি বাসায় নিয়ে যাই।'
সোহিনী বললে, 'সেই ভালো। অনুরোধ করে খাওয়ানো আমার স্বামীর আইনে বারণ। তিনি বলতেন, মানুষ তো অজগরের জাত নয়।'
একটা বড়ো টিফিন-ক্যারিয়রে থাকে থাকে সোহিনী খাবার সাজিয়ে দিলে। নীলাকে বলল,'দে তো মা, সাজিতে ফুলগুলি ভালো করে সাজিয়ে। এক জাতের সঙ্গে আর-এক জাত মিশিয়ে দিস নে যেন। আর তোর খোঁপা ঘিরে ঐ যে সিল্কের রুমাল জড়িয়েছিস, ওটা পেতে দিস ফুলগুলির উপরে।'
বিজ্ঞানীর চোখে আর্টপিপাসুর দৃষ্টি উঠল উৎসুক হয়ে। এ যে প্রাকৃত জগতের মাপ-ওজনের বাইরেকার জিনিস। নানা রঙের ফুলগুলির মধ্যে নীলার সুঠাম আঙুল সাজাবার লয় রেখে নানা ভঙ্গিতে চলছিল-- রেবতীর চোখ ফেরানো দায় হল। মাঝে মাঝে নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছিল। এক দিকে সেই মুখের সীমানা দিয়েছে চুনিমুক্তোপান্নার-মিশোলকরা একহারা হার জড়ানো চুলের ইন্দ্রধনু, আর-এক দিকে বসন্তীরঙা কাঁচুলির উচ্ছ্রিত রাঙা পাড়টি। সোহিনী মিষ্টান্ন সাজাচ্ছিল কিন্তু ওর একটা তৃতীয় নেত্র আছে যেন। সামনে যে একটা জাদু চলছিল সে ওর লক্ষ্য এড়ায় নি। নিজের স্বামীর অভিজ্ঞতা অনুসারে সোহিনীর ধারণা ছিল বিদ্যাসাধনার বেড়া-দেওয়া খেত যে-সে গোরুর চরবার খেত নয়। আজ আভাস পেল বেড়া সকলের পক্ষে সমান ঘন নয়। সেটা ভালো লাগল না।

পরের দিন সোহিনী অধ্যাপককে ডেকে পাঠালে। বললে, 'নিজের গরজে আপনাকে ডেকে এনে মিছিমিছি কষ্ট দিই। হয়তো কাজের ক্ষতিও করি।' 'দোহাই তোমার, আরো-একটু ঘন ঘন ডেকো। দরকার থাকে তো ভালো, না থাকে তো আরো ভালো।'
'আপনি জানেন, দামী যন্ত্র সংগ্রহের নেশায় আমার স্বামীর কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকত না। মনিবদের ফাঁকি দিতেন এই নিষ্কাম লোভে। সমস্ত এসিয়ার মধ্যে এমন ল্যাবরেটরি কোথাও পাওয়া যাবে না, এই জেদ তাঁর মতো আমাকেও পেয়ে বসেছিল। এই জেদেই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, নইলে আমার মোদো রক্ত গাঁজিয়ে উঠে উপচিয়ে পড়ত চার দিকে। দেখুন চৌধুরীমশায়, নিজের স্বভাবের মধ্যে মন্দটা যা লেপটিয়ে থাকে সেটা যাঁর কাছে অসংকোচে বলতে পারি আপনি আমার সেই বন্ধু। নিজের কলঙ্কের দিকটা দেখাবার খোলসা দরজা পেলে মন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।'
চৌধুরী বললেন, 'যারা সম্পূর্ণটা দেখতে পায় তাদের কাছে সত্যকে চাপা দেবার দরকার করে না। আধা সত্যই লজ্জার জিনিস। পুরোপুরি দেখার ধাত আমাদের, আমরা বিজ্ঞানী।'
'তিনি বলতেন, মানুষ প্রাণপণে প্রাণ বাঁচাতে চায় কিন্তু প্রাণ তো বাঁচে না। সেইজন্যে বাঁচবার শখ মেটাবার জন্যে এমন কিছুকে সে খুঁজে বেড়ায় যা প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি। সেই দুর্লভ জিনিসকে তিনি পেয়েছেন তাঁর ল্যাবরেটরিতে। একে যদি আমি বাঁচিয়ে রাখতে না পারি তা হলেই তাঁকে চরম করে মারব স্বামীঘাতিনী হয়ে। আমি এর রক্ষক চাই, তাই খুঁজছিলুম রেবতীকে।'
'চেষ্টা করে দেখলে?'
'দেখেছি, হাতে হাতে ফল পাবার আশা আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিঁকবে না।'
'কেন।'
'ওঁর পিসিমা যেমনি শুনবেন রেবতীকে টেনেছি কাছে, অমনি তাঁকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবার জন্যে ছুটে আসবেন। ভাববেন, আমার মেয়ের সঙ্গে ওঁর বিয়ে দেবার ফাঁদ পেতেছি।'
'দোষ কী, হলে তো ভালোই হত। কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, বেজাতে মেয়ের বিয়ে দেবে না।'
'তখনো আপনার মন জানতুম না, তাই মিথ্যে কথা বলেছিলুম। খুবই চেয়েছিলুম। কিন্তু ছেড়েছি সেই মতলব।'
'কেন।'
'বুঝতে পেরেছি, ও ভাঙনধরানো মেয়ে। ওর হাতে যা পড়বে তা আস্ত থাকবে না।'
'কিন্তু ও তো তোমারই মেয়ে।'
'আমারই মেয়ে তো বটে, তাই তো ওকে আঁতের ভিতর থেকেই চিনি।'
অধ্যাপক বললেন, 'কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে কেন যে, মেয়েরা পুরুষের ইন্‌স্পিরেশন জাগাতে পারে।'
'আমার সবই জানা আছে। পুরুষের খোরাকে আমিষ পর্যন্ত ভালোই চলে কিন্তু মদ ধরালেই সর্বনাশ। আমার মেয়েটি মদের পাত্র, কানায় কানায় ভরা।'
'তা হলে কী করতে চাও বলো।'
'আমার ল্যাবরেটরি দান করতে চাই পাবলিককে।'
'তোমার একমাত্র মেয়েকে এড়িয়ে দিয়ে?'
'মেয়েকে? ওকে দান করলে সে দান পৌঁছবে কোন্‌ রসাতলে কী করে জানব। আমার ট্রাস্ট সম্পত্তির প্রেসিডেন্ট করে দেব রেবতীকে। তাতে তো পিসির আপত্তি হতে পারবে না?'
'মেয়েদের আপত্তির যুক্তি যদি ধরতেই পারব তা হলে পুরুষ হয়ে জন্মাতে গেলুম কেন। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি নে, ওকে যদি জামাই না করবে তা হলে প্রেসিডেন্ট করতে চাও কেন।'
'শুধু যন্ত্রগুলো নিয়ে কী হবে। মানুষ চাই ওদের প্রাণ দিতে। আর-একটা কথা এই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটাও নতুন যন্ত্র আনা হয় নি। টাকার অভাবে নয়। কিনতে হলে একটা লক্ষ্য ধরে কিনতে হয়। খবর জেনেছি, রেবতী ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্‌ নিয়ে কাজ করেছেন। সেই পথে সংগ্রহ এগিয়ে চলুক, যত দাম লাগে লাগুক্‌-না।'
'কী আর বলব, পুরুষমানুষ যদি হতে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে নেচে বেড়াতুম। তোমার স্বামী রেল-কোম্পানির টাকা চুরি করেছিলেন, তুমি চুরি করে নিয়েছ তাঁর পুরুষের মনখানা। এমন অদ্ভুত কলমের জোড়-লাগানো বুদ্ধি আমি কখনো দেখি নি। আমারও পরামর্শ নেওয়া তুমি যে দরকার বোধ কর, এই আশ্চর্য।'
'তার কারণ আপনি যে খুব খাঁটি, ঠিক কথা বলতে জানেন।'
'হাসালে তুমি। তোমাকে বেঠিক কথা ব'লে ধরা পড়ব, এত বড়ো নিরেট বোকা আমি নই। তা হলে লাগা যাক এবার, জিনিসপত্র ফর্দ করা, দর যাচাই করা, ভালো উকিল ডেকে তোমার স্বত্ব বিচার করা, আদনকানুন বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি অনেক হাঙ্গামা আছে।' 'এ-সব দায় কিন্তু আপনারই।'
'সেটা হবে নামমাত্র। বেশ ভালো করেই জান, যা তুমি বলাবে তাই বলব, যা করাবে তাই করব। আমার লাভটা এই দুবেলা দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তোমাকে যে কী চক্ষে দেখেছি তুমি তো জান না।'
সোহিনী চৌকি থেকে উঠে এসে ধাঁ করে এক হাতে চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেয়ে চট্‌ করে সরে গেল, ভালোমানুষের মতো বসল গিয়ে চৌকিতে।
'ঐ রে সর্বনাশের শুরু হল দেখছি।'
'সে ভয় যদি একটুও থাকত তা হলে কাছেও এগতুম না। এ বরাদ্দ আপনার জুটবে মাঝে মাঝে।'
'ঠিক বলছ?'
'ঠিকই বলছি। আমার এতে খরচ নেই, আপনারও যে বেশি কিছু পাওনা আছে, মুখের ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছে না।
'অর্থাৎ বলতে চাও, এ হচ্ছে মরা কাঠে কাঠঠোকরার ঠোকর দেওয়া। -- চললুম উকিলবাড়িতে।'
'কাল একবার আসবেন এ পাড়াতে।'
'কেন, কী করতে।'
'রেবতীর মনে দম দিতে।'
'আর নিজের মনটা খুইয়ে বসতে।'
'মন কি আপনার একলারই আছে।'
'তোমার মনের কিছু বাকি আছে নাকি।'
'উচ্ছিষ্ট অনেক পড়ে আছে।'
'তাতে এখনো অনেক বাঁদর নাচানো চলবে।'

তার পরদিনে রেবতী ল্যাবরেটরিতে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত বিশ মিনিট আগে এসেই উপস্থিত। সোহিনী প্রস্তুত ছিল না, আটপৌরে কাপড়েই তাড়াতাড়ি চলে এল ঘরে। রেবতী বুঝতে পারলে গলদ হয়েছে। বললে, 'আমার ঘড়িটা ঠিক চলছে না দেখছি।' সোহিনী সংক্ষেপে বললে, 'নিশ্চয়।' একসময় একটু কী শব্দ শুনে রেবতী মনে মনে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালে। সুখন বেহারাটা গ্লাসকেসের চাবি নিয়ে এল ঘরে। সোহিনী জিগ্‌গেসা করলে, 'এক পেয়ালা চা আনিয়ে দেব কি।'
রেবতী ভাবলে বলা উচিত, হাঁ। বললে, 'দোষ কী।'
ও বেচারার চা অভ্যাস নেই, সর্দির আভাস দিলে বেলপাতাসিদ্ধ গরম জল খেয়ে থাকে। মনে মনে বিশ্বাস ছিল স্বয়ং নীলা আসবে পেয়ালা হাতে। সোহিনী জিগ্‌গেসা করলে, 'তুমি কি কড়া চা খাও।'
ও ফস্‌ করে বলে বসল, 'হাঁ।'
ভাবলে এ ক্ষেত্রে হাঁ বলাটাই পাকা দস্তুর। এল চা, সেটা কড়া সন্দেহ নেই। কালির মতো রঙ, নিমের মতো তিতো। চা আনলে মুসলমান খানসামা। এটাও ওকে পরীক্ষা করবার জন্যে। আপত্তি করতে ওর মুখে কথা সরল না। এই সংকোচ ভালো লাগল না সোহিনীর। খানসামাকে বললে, 'চা-টা ঢেলে দাও-না মোবারক, ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।'
খানসামার হাতের পরিবেশন-প্রত্যাশায় রেবতী বিশ মিনিট আগে এখানে আসে নি।
কী দুঃখে যে মুখে চামচ উঠছিল অন্তর্যামীই জানছিলেন, আর জানছিল সোহিনী। হাজার হোক মেয়েমানুষ, দুর্গতি দেখে বললে, 'ও পেয়ালাটা থাক্‌। দুধ ঢেলে দিচ্ছি, তার সঙ্গে কিছু ফল খেয়ে নাও। সকাল সকাল এসেছ, বোধ হয় কিছু খেয়ে আসা হয় নি।' কথাটা সত্য। রেবতী ভেবেছিল আজও সেই বোটানিকালের পুনরাবৃত্তি হবে। কাছ দিয়েও গেল না, মুখে রয়ে গেল কড়া চায়ের তিতো স্বাদ আর মনে রয়েছে আশাভঙ্গের তিতো অভিজ্ঞতা।
এমন সময়ে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক; ঘরে ঢুকেই রেবতীর পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, 'কী রে হল কী, সব যে একেবারে ঠাণ্ডা হিম। খুকুর মতো বসে বসে দুধ খাচ্ছিস ঢকে ঢক। চার দিকে যা দেখছিস একি খোকাবাবুর খেলনার দোকান। যাদের চোখ আছে তারা দেখেছে, মহাকালের চেলারা এইখানে আসে তাণ্ডবনৃত্য করতে।'
'আহা কেন বকছেন। না খেয়েই ও বেরিয়েছিল আজ সকালে। এল যখন, তখন দেখলুম মুখ যেন শুকনো।'
'ঐ রে পিসিমা দি সেকেণ্ড। এক পিসিমা দেবে এক গালে চাপড়, আর-এক পিসিমা দেবে অন্য গালে চুমো। মাঝখানে প'ড়ে ছেলেটা যাবে ভিজে কাদা হয়ে। আসল কথা কী জান, লক্ষ্মী যখন আপনি সেধে আসেন চোখে পড়েন না; যারা সাত মুল্লুক ঘুরে তাঁকে খুঁজে বের করে, ধরা দেন তিনি তাদেরই কাছে। না-চেয়ে পাওয়ার মতো না-পাওয়ার আর রাস্তা নেই। আচ্ছা বলো দেখি মিসেস-- দূর হোক গে ছাই মিসেস, আমি ডাকবই তোমাকে সোহিনী ব'লে, এতে তুমি রাগই কর আর যাই কর।'
'মরণ আমার, রাগ করতে যাব কেন। ডাকুন আমাকে সোহিনী ব'লে, সুহি বললে আমার কান জুড়িয়ে যাবে।
'গোপন কথাটা প্রকাশ করেই বলি। তোমার ঐ সোহিনী নামটির সঙ্গে আর-একটি শব্দের মিল আছে, বড়ো খাঁটি তার অর্থ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হিনি হিনি কিনি কিনি রবে ঐ দুটি শব্দ মিলিয়ে মনে মনে খঞ্জনি বাজাতে থাকি।'
'কেমিস্ট্রির রিসর্চে মিল করা আপনার অভ্যাস আছে, ওটা তারই একটা ফেঁকড়া।'
'মিল করতে গিয়ে মরেও অনেক লোক। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে নেই-- ঘোরতর দাহ্য পদার্থ।'
এই ব'লে হাঃ হাঃ শব্দে উচ্চহাস্য করে উঠলেন।
'নাঃ, ঐ ছোকরাটার সামনে এ-সব কথার আলোচনা করতে নেই। বারুদের কারখানায় আজ পর্যন্ত ও অ৻াপ্রেন্টিসি শুরু করে নি। পিসিমার আঁচল ওকে আগলে আছে, সে আঁচল নন্‌কম্‌বাস্টিব্‌ল্‌।'
রেবতীর মেয়েলি মুখ লাল হয়ে উঠছিল।
'সোহিনী, আমি তোমাকে জিগ্‌গেসা করতে যাচ্ছিলুম, আজ সকালে তুমি কি ওকে আফিম খাইয়ে দিয়েছিলে। অমন ঝিমিয়ে পড়ছে কেন।'
'খাইয়ে যদি থাকি সেটা না জেনে।'
'রেবু, ওঠ্‌ বলছি ওঠ্‌। মেয়েদের কাছে অমন মুখচোরা হয়ে থাকতে নেই। ওতে ওদের আস্পর্ধা বেড়ে যায়। ওরা তো ব্যামোর মতো পুরুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়, ছিদ্র পেলেই টেম্পারেচর চড়িয়ে দেয় হু হু ক'রে। সাবজেক্টটা জানা আছে, ছেলেগুলোকে সাবধান করতে হয়। আমার মতো যারা ঘা খেয়েছে, মরে নি, তাদের কাছ থেকেই পাঠ নিতে হয়। রেবু, কিছু মনে করিস নে বাবা। যারা কথা কয় না, চুপ করে থাকে, তারাই সব চেয়ে ভয়ংকর। চল্‌ দেখি, তোকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ঐ দেখ্‌ দুটো গ্যালভানোমিটর,একেবারে হাল কায়দার। এই দেখ্‌ হাই ভ্যাকুয়ম পম্প্‌, আর এটা মাইক্রোফোটোমিটার, এ ছেলে-পাস-করাবার কলার ভেলা নয়। একবার এখানে আসন গেড়ে বোস দেখি। সেই তোমার টাকপড়া মাথার প্রোফেসর-- নাম করতে চাই নে-- দেখি কেমন তার মুখ চুন হয়ে না যায়। আমার ছাত্র হয়ে যখন তুই বিদ্যে শুরু করলি আমি তোকে বলি নি কি, তোর নাকের সামনে ঝুলছে যাকে কথায় বলে 'ভবিষ্যৎ'। হেলাফেলা করে সেটাকে ফোঁপরা করে দিস নে যেন। তোর জীবনীর প্রথম চ্যাপ্‌টারের এক কোণে আমার নামটাও ছোটো অক্ষরে লেখা যদি থাকে, সেটা হবে আমার মস্ত গুরুদক্ষিণা।'
দেখতে দেখতে বিজ্ঞানী জেগে উঠল। জ্বলে উঠল তার দুই চোখ। চেহারাটা একেবারে ভিতর থেকে গেল বদলে। মুগ্ধ হয়ে সোহিনী বললে, 'তোমাকে যে-কেউ জানে তারা সকলেই তোমার এত বড়ো উন্নতির আশা করে যা প্রতিদিনের জিনিস নয়, যা চিরদিনের। কিন্তু আশা যতই বড়ো, ততই বড়ো তার বাধা ভিতরে বাইরে।'
অধ্যাপক রেবতীর পিঠে আর-একবার দিলে একটা মস্ত চাপড়। ঝন্‌ঝন্‌ করে উঠল তার শিরদাঁড়া। চৌধুরী তাঁর মস্ত ভারী গলায় বললেন, 'দেখ্‌ রেবু, যে মহৎ ভবিষ্যতের বাহন হওয়া উচিত ছিল ঐরাবত, কৃপণ বর্তমান চাপিয়ে দেয় তাকে গোরুর গাড়িতে, কাদায় পড়ে থাকে সে অহল হয়ে। শুনছ, সোহিনী, সুহি? -- না না ভয় নেই, পিঠে চাপড় মারব না। বলো সত্যি ক'রে কথাটা আমি কেমন গুছিয়ে বলেছি।'
'চমৎকার।'
'ওটা লিখে রেখো তোমার ডায়ারিতে।'
'তা রাখব।'
'কথাটার মানেটা বুঝেছিস তো রেবি?'
'বোধ হয় বুঝেছি।'
'মনে রাখিস মস্ত প্রতিভার মস্ত দায়িত্ব। ও তো কারো নিজের জিনিস নয়। ওর জবাবদিহি অনন্তকালের কাছে। শুনছ সুহি, শুনছ? কথাটা কেমন বলেছি বলো তো ভাই।'
'খুব ভালো বলেছেন। আগেকার দিনের রাজা থাকলে গলা থেকে মালা খুলে--'
'তারা তো মরেছে সব, কিন্তু--'
'ঐ কিন্তুটুকু মরে নি, মনে থাকবে।'
রেবতী বললে, 'ভয় নেই, কিছুতে আমাকে দুর্বল করবে না।'
সোহিনীকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেল। সোহিনী তাড়াতাড়ি আটকিয়ে দিলে।
চৌধুরী বললেন, 'আরে করলে কী। পুণ্যকর্ম না করার দোষ আছে, পুণ্যকর্মে বাধা দেওয়ার দোষ আরো বেশি।'
সোহিনী বললে, 'প্রণাম যদি করতে হয় তো ঐখানে।'-- ব'লে বেদীর উপরে বসানো নন্দকিশোরের মূর্তি দেখিয়ে দিলে। ধূপধুনো জ্বলছে, ফুলে ভরে আছে থালা।
বললে, 'পাতকীকে উদ্ধার করার কথা পুরাণে পড়েছি। আমাকে উদ্ধার করেছেন ঐ মহাপুরুষ। অনেক নীচে নামতে হয়েছিল, শেষকালে তুলে বসাতে পেরেছেন-- পাশে বললে মিথ্যে হবে, তাঁর পায়ের তলায়। বিদ্যার পথে মানুষকে উদ্ধার করবার দীক্ষা তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন। বলে গিয়েছেন যেন মেয়েজামাইয়ের গুমর বাড়াবার জন্যে তাঁর জীবনের খনিখোঁড়া রত্ন ছাইয়ের গাদায় হারিয়ে না ফেলি। বললেন, ঐখানে রেখে গেলেম আমার সদ্‌গতি, আর সদ্‌গতি আমার দেশের।'
অধ্যাপক বললেন, 'শুনলি তো রেবু? এটা হবে ট্রাস্ট সম্পত্তি, তোকে দেওয়া হবে তার কর্তৃত্ব।'
রেবতী ব্যস্ত হয়ে বললে, 'কর্তৃত্ব নেবার যোগ্য আমি নই। আমি পারব না।'
সোহিনী বললে, 'পারবে না! ছি, এ কি পুরুষের মতো কথা।'
রেবতী বললে, 'আমি চিরদিন পড়াশুনো করে এসেছি, এরকম কাজের ভার কখনো নিই নি।'
চৌধুরী বললেন, 'ডিম ফোটাবার আগে কখনো হাঁস সাঁতার দেয় নি। আজ তোমার ডিমের খোলা ভাঙবে।'
সোহিনী বললে, 'ভয় নেই তোমার, আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব।'
রেবতী আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল।
সোহিনী অধ্যাপকের মুখের দিকে চেয়ে রইল। চৌধুরী বললেন, 'জগতে বোকা অনেকরকম আছে, পুরুষ বোকা সকল বোকার সেরা। কিন্তু মনে রেখো, দায়িত্ব হাতে না পেলে দায়িত্বের যোগ্যতা জন্মায় না। একজোড়া হাত পেয়েছে মানুষ তাই সে হয়েছে মানুষ, একজোড়া খুর পেলেই তার সঙ্গে সঙ্গে মলবার যোগ্য লেজ আপনি গজিয়ে উঠত। তুমি কি রেবতীর হাতের বদলে খুর দেখতে পেয়েছ নাকি।'
'না, আমার ভালো লাগছে না। মেয়ের হাতেই যারা মানুষ কোনো কালে তাদের দুধে-দাঁত ভাঙে না। কপাল আমার। আপনি থাকতে আমি আর-কারো কথা কেন ভাবতে গেলুম।'
'খুশি হলুম শুনে। একটুখানি বুঝিয়ে দাও কী গুণ আছে আমার।'
'লোভ নেই আপনার একটুও।'
'এত বড়ো নিন্দের কথা! লোভের মতো জিনিসকে লোভ করি নে?-- খুবই করি--'
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাঁর দুই গালে দুই চুমো দিয়ে সোহিনী সরে গেল।
'কোন্‌ খাতায় জমা হল এটা সোহিনী।'
'আপনার কাছে যে ঋণ পেয়েছি সে তো শোধ করতে পারি নে, তারই সুদ দিচ্ছি।'
'প্রথম দিন পেয়েছি একটি, আজ পেলুম দুটি। কেবলই বেড়ে চলবে নাকি।'
'বাড়বে বৈকি, চক্রবৃদ্ধির নিয়মে।'

চৌধুরী বললেন, 'সোহিনী, তোমার স্বামীর শ্রাদ্ধে শেষকালে আমাকে পুরুত বানিয়ে দিলে? সর্বনাশ, এ কি কম দায়িত্ব। যার অস্তিত্ব হাতড়িয়ে পাওয়া যায় না তাকে খুশি করা! এ তো বাঁধাদস্তুরের দানদক্ষিণে নয় যে--'
'আপনিও তো বাঁধাদস্তুরের গুরুঠাকুর নন, আপনি যা করবেন সেটাই হবে পদ্ধতি। দানের ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছেন তো?'
'কদিন ধরে ঐ কাজই করেছি, দোকানবাজার কম ঘুরি নি। দানসামগ্রী সাজানো হয়ে গেছে নীচের বড়ো ঘরটাতে। ইহলোকস্থিত আত্মা যারা এগুলো আত্মসাৎ করবে তারা পেট ভরে খুশি হবে, সন্দেহ নেই।'
চৌধুরীর সঙ্গে নীচে গিয়ে সোহিনী দেখলে, সায়ান্স-পড়ুয়া ছেলেদের জন্যে নানা যন্ত্র, নানা মডেল, নানা দামী বই, নানা মাইক্রোস্‌কোপের স্লাইড্‌স্‌ নানা বায়োলজির নমুনা। প্রত্যেক সামগ্রীর সঙ্গে নাম ও ঠিকানা-লেখা কার্ড। আড়াইশো ছেলের জন্যে চেক লেখা হয়েছে এক বৎসরের বৃত্তির। খরচের জন্যে কিছুমাত্র সংকোচ করা হয় নি। বড়ো বড়ো ধনীদের শ্রাদ্ধে যে ব্রাহ্মণবিদায় হয় তার চেয়ে এর ব্যয়ের প্রসর অনেক বেশি, অথচ বিশেষ করে চোখে পড়ে না এর সমারোহ।
'পুরুতবিদায়ের কী দক্ষিণা দিতে হবে, সেটা তো আপনি ধরে দেন নি।'
'আমার দক্ষিণা তোমার খুশি।'
'খুশির সঙ্গে সঙ্গে আপনার জন্যে রেখেছি এই ক্রনোমিটার। জর্মনি থেকে আমার স্বামী এটা কিনেছিলেন, বরাবর তাঁর রিসর্চের কাজে লেগেছিল।' চৌধুরী বললেন, 'যা মনে আসছে তার ভাষা নেই। বাজে কথা বলতে চাইনে, আমার পুরুতের কাজ সার্থক হল।'
'আর-একটি লোক আছে, আজ তাকে ভুলতে পারি নে-- সে আমাদের মানিকের বিধবা বউ।'
'মানিক বলতে কাকে বোঝায়।'
'সে ছিল ওঁর ল্যাবরেটরির হেড মিস্ত্রি। আশ্চর্য তার হাত ছিল। অত্যন্ত সূক্ষ্ণ কাজে এক চুল তার নড়্‌চড়্‌ হত না, কলকব্‌জার তত্ত্ব বুঝে নিতে তার বুদ্ধি ছিল অভ্রান্ত। তাকে উনি অতিনিকট বন্ধুর মতো দেখতেন। গাড়ি করে নিয়ে যেতেন বড়ো বড়ো কারখানায় কাজ দেখাতে। এদিকে সে ছিল মাতাল, ওঁর অ৻াসিস্টেন্টরা তাকে ছোটোলোক ব'লে অবজ্ঞা করত। উনি বলতেন, ও যে গুণী, তার সে গুণ বানিয়ে তোলা যায় না, সে গুণ খুঁজে মিলবে না। ওঁর কাছে তার সম্মান পুরোমাত্রায় ছিল। এর থেকে বুঝবেন কেন যে উনি আমাকে শেষ পর্যন্ত এত মান দিয়েছিলেন। আমার মধ্যে যে মূল্য তিনি দেখেছিলেন তার তুলনায় দোষের ওজন ওঁর কাছে ছিল খুব সামান্য। যে জায়গায় আমার মতো কুড়িয়ে-পাওয়া মেয়েকে তিনি অসম্ভব রকম বিশ্বাস করেছিলেন, সে জায়গায় সে বিশ্বাস আমি কোনোদিন একটুমাত্র নষ্ট করি নি। আজও মনপ্রাণ দিয়ে রক্ষা করছি। এতটা তিনি আর-কারো কাছে পেতেন না। যেখানে আমি ছিলেম ছোটো সেখানে আমি তাঁর চোখে পড়ি নি, যেখানে আমি ছিলুম বড়ো সেখানে তিনি আমাকে পুরো সম্মান দিয়েছেন। আমার মূল্য যদি তাঁর চোখে না পড়ত তা হলে আমি কোথায় তলিয়ে যেতুম বলুন তো। আমি খুব খারাপ, কিন্তু আমি নিজেই বলছি আমি খুব ভালো, নইলে তিনি আমাকে কখনো সহ্য করতে পারতেন না।'
'দেখো সোহিনী, আমি অহংকার করে বলব যে আমি প্রথম থেকেই জেনেছি তুমি খুব ভালো। সস্তা দরের ভালো হলে কলঙ্ক লাগলে দাগ উঠত না।'
'যাক গে, আমাকে আর যে লোক যা মনে করুক-না, তিনি আমাকে যা মান দিয়েছেন, সে আজ পর্যন্ত টিঁকে আছে, আমার শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে।'
'দেখো সোহিনী, তোমাকে যত দেখছি ততই জানছি, তুমি সে জাতের সহজ মেয়েমানুষ নও যারা স্বামী নামটা শুনলেই গ'লে পড়ে।'
'না, তা নই; আমি দেখেছি ওঁর মধ্যে শক্তি, প্রথম দিন থেকে জেনেছি উনি মানুষ, আমি শাস্ত্র মিলিয়ে পতিব্রতাগিরি করতে বসি নি। আমি জাঁক করেই বলছি, আমার মধ্যে যে রত্ন আছে সে একা ওঁরই কণ্ঠহারে দোলবার মতো, আর কারো নয়।'
এমন সময় নীলা ঘরে এসে ঢুকে পড়ল। বললে,'অধ্যাপকমশায়, কিছু মনে করবেন না, মায়ের সঙ্গে কিছু কথা আছে।'
'কিচ্ছু না মা, আমি এখন যাচ্ছি ল্যাবরেটরিতে। রেবতী কী রকম কাজ করছে দেখে আসি গে।'
নীলা বললে, 'কোনো ভয় নেই। কাজ ভালোই চলছে। আমি এক-একদিন জানালার বাইরে থেকে দেখছি, উনি মাথা গুঁজে লিখছেন, নোট নিচ্ছেন, কলম কামড়ে ধরে ভাবছেন। আমার প্রবেশ নিষেধ, পাছে সার আইজাকের গ্রাভিটেশন যায় ন'ড়ে। সেদিন মা কাকে বলছিলেন উনি ম্যাগ্‌নেটিজম্‌ নিয়ে কাজ করছেন,তাই পাশ দিয়ে কেউ গেলেই কাঁটা নড়ে যায়, বিশেষত মেয়েরা।'
চৌধুরী হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, 'মা, ল্যাবরেটরি ভিতরেই আছে, ম্যাগ্‌নেটিজম্‌ নিয়ে কাজ চলছেই, কাঁটা যাঁরা নড়িয়ে দেন তাঁদের ভয় করতেই হয়। দিগ্‌ভ্রম ঘটায় যে। তবে চললুম।'
নীলা মাকে বললে, 'আমাকে আর কতদিন তোমার আঁচলের গাঁট দিয়ে বেঁধে রাখবে। পেরে উঠবে না, কেবল দুঃখ পাবে।'
'তুই কী করতে চাস বল্‌।'
নীলা বললে, 'তুমি তো জানই মেয়েদের জন্যে একটা হাইয়র স্টাডি মুভমেন্ট খোলা হয়েছে, তুমি তাতে অনেক টাকা দিয়েছ। সেখানে আমাকে কেন কাজে লাগাও-না।'
'আমার ভয় আছে পাছে তুই ঠিকমতো না চলিস।'
'সব চলাই বন্ধ করে দেওয়াই কি ঠিক চলার রাস্তা।
'তা নয়, তা তো জানি, সেই তো আমার ভাবনা।'
'তুমি না ভেবে একবার আমাকে ভাবতে দাও না। সে তো দিতেই হবে। আমি তো এখন খুকি নই। তুমি ভাবছ সেই-সব পাবলিক জায়গায় নানা লোকের যাওয়া-আসা আছে, সে একটা বিপদ। জগৎ-সংসারে লোকচলাচল তো বন্ধ হবে না তোমার খাতিরে। আর তাদের সঙ্গে আমার জানাশুনো একেবারেই ঠেকিয়ে রাখবে যে সে আইন তো তোমার হাতে নেই।'
'জানি সব জানি, ভয় করে ভয়ের কারণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তা হলে তুই ওদের হাইয়র স্টাডি সার্কলে ভরতি হতে চাস?'
'হাঁ চাই।'
'আচ্ছা তাই হবে। সেখানকার পুরুষ অধ্যাপকদের একে একে দিবি জাহান্নমে সে জানি। কেবল একটি কথা দিতে হবে আমাকে। কোনোমতেই তুই রেবতীর কাছে ঘেঁষতে পাবি নে। আর কোনো ছুতোতেই ঢুকবি নে তার ল্যাবরেটরিতে।'
'মা, তুমি আমাকে কী মনে কর ভেবে পাই নে। কাছে ঘেঁষতে যাব তোমার ঐ খুদে সার আইজাক নিউটনের, এমন রুচি আমার?-- মরে গেলেও না।'
সংকোচ বোধ করলে রেবতী শরীরটাকে নিয়ে যেরকম আঁকুবাঁকু করে তারই নকল ক'রে নীলা বললে, 'ঐ স্টাইলের পুরুষকে নিয়ে আমার চলবে না। যে-সব মেয়েরা ভালোবাসে বুড়ো খোকাদের মানুষ করতে, ওকে জিইয়ে রেখে দেওয়া ভালোতাদেরই জন্যে। ও মারবার যোগ্য শিকারই নয়।'
'একটু বেশি বাড়িয়ে কথা বলছিস নীলা, তাই ভয় হচ্ছে ওটা ঠিক তোর মনের কথা নয়। তা হোক, ওর সম্বন্ধে তোর মনের ভাব যাই হোক, ওকে যদি মাটি করতে চাস তা হলে সে তোর পক্ষে ভালো হবে না।'
'কখন তোমার কী মর্জি কিছুই বুঝতে পারি নে মা। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার জন্যে তুমি আমাকে সাজিয়ে পুতুল গড়ে তুলেছিলে, সে কি আমি বুঝতে পারি নি। সেইজন্যেই কি তুমি আমাকে ওর বেশি কাছে আনাগোনা করতে বারণ করছ, পাছে, চেনাশোনার ঘেঁষ লেগে পালিশ নষ্ট হয়ে যায়।'
'দেখ্‌ নীলা, আমি তোকে ব'লে দিচ্ছি তোর সঙ্গে ওর বিয়ে কিছুতেই হতে পারবে না।'
'তা হলে আমি যদি মোতিগড়ের রাজকুমারকে বিয়ে করি?'
'ইচ্ছা হয় তো করিস।'
'সুবিধে আছে, তার তিনটে বিয়ে, আমার দায় অনেকটা হালকা হবে, আর সে মদ খেয়ে ঢলাঢলি করে নাইটক্লাবে-- তখন আমি অনেকটা ছুটি পাব।'
'আচ্ছা বেশ, সেই ভালো। রেবতীর সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।'
'কেন, তোমার সার আইজাক নিউটনের বুদ্ধি আমি ঘুলিয়ে দেব মনে কর?'
'সে তর্ক থাক্‌, যা বললুম তা মনে রাখিস।'
'উনি নিজেই যদি হ্যাংলাপনা করেন।'
'তা হলে এ পাড়া তাকে ছাড়তে হবে-- তোর অন্নে তাকে মানুষ করিস, তোর বাপের তহবিল থেকে এক কড়িও সে পাবে না।'
'সর্বনাশ! তা হলে নমস্কার সার আইজাক নিউটন।'
সেদিনকার পালা সংক্ষেপে এই পর্যন্ত।

'চৌধুরীমশায়, আর সবই চলছে ভালো কেবল আমার মেয়ের ভাবনায় সুস্থির হতে পারছি নে। ও যে কোন্‌ দিকে তাক করতে শুরু করেছে বুঝতে পারছি নে।'
চৌধুরী বললেন, 'আবার ওর দিকে তাক করছে কারা সেটাও একটা ভাববার কথা। হয়েছে কি, এরই মধ্যে রটে গেছে ল্যাবরেটরি রক্ষার জন্যে তোমার স্বামী অগাধ টাকা রেখে গেছে। মুখে মুখে তার অঙ্কটা বেড়েই চলেছে। এখন রাজত্ব আর রাজরন্যা নিয়ে বাজারে একটা জুয়াখেলার সৃষ্টি হয়েছে।'
রাজকন্যাটি মাটির দরে বিকোবে তা জানি, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে রাজত্ব সস্তায় বিকোবে না।'
'কিন্তু লোকের আমদানি শুরু হয়েছে। সেদিন হঠাৎ দেখি, আমাদেরই অধ্যাপক মজুমদার ওরই হাত ধরে বেরিয়ে এল সিনেমা থেকে। আমাকে দেখেই ঘাড় বেঁকিয়ে নিল। ছেলেটা ভালো ভালো বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়, দেশের মঙ্গলের দিকে ওর বুলি খুব সহজে খেলে। কিন্তু সেদিন ওর বাঁকা ঘাড় দেখে স্বদেশের জন্যে ভাবনা হল।'
'চৌধুরীমশায়, আগল ভেঙেছে।'
'ভেঙেছে বৈকি। এখন এই গরিবকেই নিজের ঘটিবাটি সামলাতে হবে।'
'মজুমদার-পাড়ায় মড়ক লাগে লাগুক, আমার ভয় রেবতীকে নিয়ে।'
চৌধুরী বললেন, 'আপাতত ভয় নেই। খুব ডুবে আছে। কাজ করছে খুব চমৎকার।'
'চৌধুরীমশায়, ওর বিপদ হচ্ছে সায়ান্সে ও যত বড়ো ওস্তাদই হোক, তুমি যাকে মেট্রিয়ার্কি বল সে রাজ্যের ও ঘোর আনাড়ি।'
'সে কথা ঠিক। ওর একবারও টিকে দেওয়া হয় নি। ছোঁয়াচ লাগলে বাঁচানো শক্ত হবে।'
'রোজ একবার কিন্তু ওকে আপনাকে দেখে যেতে হবে।'
'কোথা থেকে ও আবার ছোঁয়াচ না নিয়ে আসে। শেষকালে এ বয়সে আমি না মরি। ভয় কোরো না, মেয়েমানুষ যদিও, তবুও আশা করি ঠাট্টা বুঝতে পার। আমি পার হয়ে গেছি এপিডেমিকের পাড়াটা। এখন ছোঁওয়া লাগলেও ছোঁয়াচ লাগে না। কিন্তু একটা মুশকিল ঘটেছে। পরশু আমাকে যেতে হবে গুজরানওয়ালায়।'
'এটাও ঠাট্টা নাকি। মেয়েমানুষকে দয়া করবেন।'
'ঠাট্টা নয়, আমার সতীর্থ অমূল্য আড্ডি ছিলেন সেখানকার ডাক্তার। বিশপঁচিশ বছর প্র্যাকটিস করেছেন। কিছু বিষয়সম্পত্তিও জমিয়েছেন। হঠাৎ বিধবা স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে রেখে মরেছেন হার্টফেল করে। দেনাপাওনা চুকিয়ে জমিজমা বেচে তাদের উদ্ধার করে আনতে হবে আমাকে। কতদিন লাগবে ঠিক জানি নে।'
'এর উপরে আর কথা নেই।'
'এ সংসারে কথা কিছুরই উপরে নেই সোহিনী। নির্ভয়ে বলো, যা হবেই তা হোক। যারা অদৃষ্ট মানে তারা ভুল করে না। আমরা সায়ান্টিস্ট্‌রাও বলি অনিবার্যের এক চুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই। যতক্ষণ কিছু করবার থাকে করো, যখন কোনোমতেই পারবে না, বোলো বাস্‌।'
'আচ্ছা তাই ভালো।'
'যে মজুমদারটির কথা বললুম,দলের মধ্যে সে তত বেশি মারাত্মক নয়। তাকে ওরা দলে টেনে রাখে মান বাঁচাবার জন্যে। আর-যাদের কথা শুনেছি, চাণক্যের মতে তাদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকলেও ভাবনার কারণ থেকে যায়। অ৻াটর্নি আছে বঙ্কুবিহারী, তাকে আশ্রয় করা আর অক্টোপসকে জড়িয়ে ধরা একই কথা। ধনী বিধবার তপ্ত রক্ত এই-সব লোক পছন্দ করে। খবরটা শুনে রাখো, যদি কিছু করবার থাকে কোরো। সবশেষে আমার ফিলজফিটা মনে রেখো।'
'দেখুন চৌধুরীমশায়, রেখে দিন ফিলজফি। মানব না আপনার অদৃষ্ট, মানব না আপনার কার্যকারণের অমোঘ বিধান, যদি আমার ল্যাবরেটরির 'পরে কারো হাত পড়ে। আমি পাঞ্জাবের মেয়ে, আমার হাতে ছুরি খেলে সহজে। আমি খুন করতে পারি তা সে আমার নিজের মেয়ে হোক, আমার জামাইপদের উমেদার হোক।'
ওর শাড়ির নীচে ছিল কোমরবন্ধ লুকোনো। তার থেকে ধাঁ করে এক ছুরি বের করে আলোয় ঝলক খেলিয়ে দিয়ে গেল। বললে,'তিনি আমাকে বেছে নিয়েছিলেন-- আমি বাঙালির মেয়ে নই, ভালোবাসা নিয়ে কেবল চোখের জল ফেলে কান্নাকাটি করি নে। ভালোবাসার জন্যে প্রাণ দিতে পারি, প্রাণ নিতে পারি। আমার ল্যাবরেটরি আর আমার বুকের কলিজা, তার মাঝখানে রয়েছে এই ছুরি।'
চৌধুরী বললেন, 'এক সময়ে কবিতা লিখতে পারতুম,আজ আবার মনে হচ্ছে হয়তো পারি লিখতে।'
'কবিতা লিখতে হয় লিখবেন, কিন্তু আপনার ফিলজফি ফিরিয়ে নিন। যা না মানবার তাকে আমি শেষ পর্যন্ত মানব না। একলা দাঁড়িয়ে লড়ব। আর বুক ফুলিয়ে বলব, জিতবই, জিতবই, জিতবই।'
'ব্র্যাভো, আমি ফিরিয়ে নিলুম আমার ফিলজফিটা। এখন থেকে লাগাব ঢাকে চাঁটি তোমার জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে। আপতত কিছুদিনের জন্যে বিদায় নিচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে না।'
আশ্চর্যের কথা এই সোহিনীর চোখে জল ভরে এল। বললে, 'কিছু মনে করবেন না।' জড়িয়ে ধরলে চৌধুরীর গলা। বললে, 'সংসারে কোনো বন্ধনই টেঁকে না, এও মুহূর্তকালের জন্যে।'
ব'লেই গলা ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে প'ড়ে সোহিনী অধ্যাপককে প্রণাম করলে।

১০

খবরের কাগজে যাকে বলে 'পরিস্থিতি' সেটা হঠাৎ এসে পড়ে, আর আসে দল বেঁধে। জীবনের কাহিনী সুখে দুঃখে বিলম্বিত হয়ে চলে। শেষ অধ্যায়ে কোলিশন লাগে অকস্মাৎ, ভেঙেচুরে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিধাতা তাঁর গল্প গড়েন ধীরে ধীরে, গল্প ভাঙেন এক ঘায়ে।
সোহিনীর আইমা থাকেন আম্বালায়। সোহিনী তার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছে, 'যদি দেখা করতে চাও শীঘ্র এসো।'
এই আইমা তার একমাত্র আত্মীয় যে বেঁচে আছে। এরই হাত থেকে নন্দকিশোর কিনে নিয়েছিলেন সোহিনীকে।
নীলাকে তার মা বললে,'তুমিও আমার সঙ্গে এসো।'
নীলা বললে, 'সে তো কিছুতেই হতে পারে না।'
'কেন পারে না।'
'ওরা আমাকে অভিনন্দন দেবে তারই আয়োজন চলছে।'
'ওরা কারা।'
'জাগানী ক্লাবের মেম্বররা। ভয় পেয়ো না, খুব ভদ্র ক্লাব। মেম্বরদের নামের ফর্দ দেখলেই বুঝতে পারবে। খুবই বাছাই করা।'
'তোমাদের উদ্দেশ্য কী।'
'স্পষ্ট বলা শক্ত। উদ্দেশ্যটা নামের মধ্যেই আছে। এই নামের তলায় আধ্যাত্মিক সাহিত্যিক আর্টিস্টিক সব মানেই খুব গভীরভাবে লুকোনো আছে। নবকুমারবাবু খুব চমৎকার ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন। ওরা ঠিক করেছে তোমার কাছ থেকে চাঁদা নিতে আসবে।'
'কিন্তু চাঁদা দেখছি ওঁরা নিয়ে শেষ করেছে। তুমি ষোলো-আনাই পড়েছ ওর হাতে। কিন্তু এই পর্যন্তই। আমার যেটা ত্যাজ্য সেটাই ওরা পেয়েছে। আমার কাছ থেকে আর কিছু পাবার নেই।'
'মা, এত রাগ করছ কেন। ওঁরা নিঃস্বার্থভাবে দেশের উপকার করতে চান।
'আচ্ছা সে আলোচনা থাক্‌। এতক্ষণে তুমি বোধ হয় তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেয়েছ যে তুমি স্বাধীন।'
'হাঁ পেয়েছি।'
'নিঃস্বার্থরা তোমাকে জানিয়েছেন যে তোমার স্বামীর দত্ত অংশে তোমার যে টাকা আছে সে তুমি যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারো।'
'হাঁ জেনেছি।'
'আমার কানে এসেছে উইলের প্রোবেট নেবার জন্যে তোমরা প্রস্তুত হচ্ছ। কথাটা বোধ হয় সত্যি?'
'হাঁ সত্যি। বঙ্কুবাবু আমার সোলিসিটর।'
'তিনি তোমাকে আরো কিছু আশা এবং মন্ত্রণা দিয়েছেন।'
নীলা চুপ করে রইল।
'তোমার বঙ্কুবাবুকে আমি সিধে করে দেব যদি আমার সীমানায় তিনি পা বাড়ান। আইনে না পারি বে আইনে। ফেরবার সময় আমি পেশোয়ার হয়ে আসব। আমার ল্যাবরেটরি রইল দিনরাত্রি চারজন শিখ সিপাইয়ের পাহারায়। আর যাবার সময় এই তোমাকে দেখিয়ে যাচ্ছি-- আমি পাঞ্জাবের মেয়ে।'
ব'লে নিজের কোমরবন্ধ থেকে ছুরি বের করে বললে, 'এ ছুরি না চেনে আমার মেয়েকে, না চেনে আমার মেয়ের সোলিসিটরকে। এর স্মৃতি রইল তোমার জিম্মায়। ফিরে এসে যদি হিসেব নেবার সময় হয় তো হিসেব নেব।'

১১

ল্যাবরেটরির চার দিকে অনেকখানি জমি ফাঁকা আছে। কাঁপন বা শব্দ যাতে যথাসম্ভব কাজের মাঝখানে না পৌঁছয়। এই নিস্তব্ধতা কাজের অভিনিবেশে রেবতীকে সহায়তা করে। তাই ও প্রায়ই এখানে রাত্রে কাজ করতে আসে।
নীচের ঘড়িতে দুটো বাজল। মুহূর্তের জন্য রেবতী তার চিন্তার বিষয় ভাবছিল জানলার বাইরে আকাশের দিকে চোখ মেলে।
এমন সময়ে দেওয়ালে পড়ল ছায়া। চেয়ে দেখে ঘরের মধ্যে এসেছে নীলা। রাত-কাপড় পরা, পাতলা সিল্কের শেমিজ। ও চমকে চৌকি থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল। নীলা এসে ওর কোলের উপর বসে গলা জড়িয়ে ধরল। রেবতীর সমস্ত শরীর থর্‌ থর্‌ করে কাঁপতে লাগল, বুক উঠতে পড়তে লাগল প্রবলবেগে। গদ্‌গদ কণ্ঠে বলতে লাগল, 'তুমি যাও, এ ঘর থেকে তুমি যাও।'
ও বললে, 'কেন।'
রেবতী বললে, 'আমি সহ্য করতে পারছি নে। কেন এলে তুমি এ ঘরে।'
নীলা ওকে আরো দৃঢ়বলে চেপে ধরে বললে, 'কেন, আমাকে কি তুমি ভালোবাস না।'
রেবতী বললে, 'বাসি, বাসি, বাসি। কিন্তু এ ঘর থেকে তুমি যাও।'
হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল পাঞ্জাবী প্রহরী; ভর্ৎসনার কণ্ঠে বললে, 'মায়িজি, বহুত শরমকি বাৎ হ্যায়, আপ বাহার চলা যাইয়ে।'
রেবতী চেতনমনের অগোচরে ইলেকট্রিক ডাকঘড়িতে কখন্‌ চাপ দিয়েছিল।
পাঞ্জাবী রেবতীকে বললে, 'বাবুজি, বেইমানি মৎ করো।'
রেবতী নীলাকে জোর করে ঠেলে দিয়ে চৌকি থেকে উঠে পড়ল। দরোয়ান ফের নীলাকে বললে,'আপ বাহার চলা যাইয়ে, নহি তো মনিবকো হুকুম তামিল করেগা।'
অর্থাৎ জোর করে অপমান করে বের করে দেবে। বাইরে যেতে যেতে নীলা বললে, 'শুনছেন সার আইজাক নিউটন?-- কাল আমাদের বাড়িতে আপনার চায়ের নেমন্তন্ন, ঠিক চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সময়। শুনতে পাচ্ছেন না? অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন?' ব'লে একবার তার দিকে ফিরে দাঁড়ালে।
বাষ্পার্দ্র কণ্ঠে উত্তর এল, 'শুনেছি।'
রাত-কাপড়ের ভিতর থেকে নীলার নিখুঁত দেহের গঠন ভাস্করের মূর্তির মতো অপরূপ হয়ে ফুটে উঠল, রেবতী মুগ্ধ চোখে না দেখে থাকতে পারল না। নীলা চলে গেল। রেবতী টেবিলের উপর মুখ রেখে পড়ে রইল। এমন আশ্চর্য সে কল্পনা করতে পারে না। একটা কোন্‌ বৈদ্যুত বর্ষণ প্রবেশ করেছে ওর শিরার মধ্যে, চকিত হয়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিধারায়। হাতের মুঠো শক্ত করে রেবতী কেবলই নিজেকে বলাতে লাগল, কাল চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না। খুব শক্ত শপথ করবার চেষ্টা করতে চায়, মুখ দিয়ে বেরয় না। ব্লটিঙের উপর লিখল, যাব না, যাব না, যাব না। হঠাৎ দেখলে তার টেবিলে একটা ঘন লাল রঙের রুমল পড়ে আছে, কোণে নাম সেলাই করা 'নীলা'। মুখের উপর চেপে ধরল রুমাল, গন্ধে মগজ উঠল ভরে, একটা নেশা সির্‌ সির্‌ করে ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে।
নীলা আবার ঘরের মধ্যে এল। বললে, 'একটা কাজ আছে ভুলে গিয়েছিলুম।'
দরোয়ান রুখতে গেল। নীলা বললে, 'ভয় নেই তোমার, চুরি করতে আসি নি। একটা কেবল সই চাই। জাগানী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করব তোমাকে-- তোমার নাম আছে দেশ জুড়ে।'
অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে রেবতী বললে, 'ও ক্লাবের আমি তো কিছুই জানি নে।'
'কিছুই তো জানবার দরকার নেই। এইটুকু জানলেই হবে ব্রজেন্দ্রবাবু এই ক্লাবের পেট্রন।'
'আমি তো ব্রজেন্দ্রবাবুকে জানি নে।'
' এইটুকু জানলেই হবে, মেট্রপলিটান ব্যাঙ্কের তিনি ডাইরেক্টর। লক্ষী আমার, জাদু আমার, একটা সই বৈ তো নয়।' ব'লে ডান হাত দিয়ে তার কাঁধ ঘিরে তার হাতটা ধরে বললে, 'সই করো।'
সে স্বপ্নাবিষ্টের মতো সই করে দিলে।
কাগজটা নিয়ে নীলা যখন মুড়ছে দরোয়ান বললে, 'এ কাগজ আমাকে দেখতে হবে।'
নীলা বললে, 'এ তো তুমি বুঝতে পারবে না।'
দরোয়ান বললে, 'দরকার নেই বোঝবার।' বলে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে। বললে, 'দলিল বানাতে হয় বাইরে গিয়ে বানিয়ো। এখানে নয়।'
রেবতী মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দরোয়ান নীলাকে বললে, 'মাজি, এখন চলো তোমাকে বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে আসি গে।' ব'লে তাকে নিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে আবার ঘরে ঢুকল পাঞ্জাবী। বললে 'চার দিকে আমি দরজা বন্ধ করে রাখি, তুমি ওকে ভিতর থেকে খুলে দিয়েছ।'
এ কী সন্দেহ, কী অপমান। বারবার করে বললে, 'আমি খুলি নি।'
'তবে ও কী করে ঘরে এল।'
সেও তো বটে। বিজ্ঞানী তখন সন্ধান করে বেড়াতে লাগল ঘরে ঘরে। অবশেষে দেখলে রাস্তার ধারের একটা বড়ো জানলা ভিতর থেকে আগল দেওয়া ছিল, কে সেই অগলটা দিনের বেলায় এক সময়ে খুলে রেখে গেছে।
রেবতীর যে ধূর্ত বুদ্ধি আছে এতটা শ্রদ্ধা তার প্রতি দরোয়ানজির ছিল না। বোকা মানুষ, পড়াশুনা করে এই পর্যন্ত তার তাকত।
অবশেষে কপাল চাপড়ে বললে, 'আওরত! এ শয়তানি বিধিদত্ত।'
যে অল্প-একটু রাত বাকি ছিল রেবতী নিজেকে বারবার করে বলালে, চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না।
কাক ডেকে উঠল। রেবতী চলে গেল বাড়িতে।

১২

পরের দিন সময়ের একটু ব্যতিক্রম হল না। চায়ের সভায় চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই রেবতী গিয়ে হাজির। ভেবেছিল এ সভা নিভৃতে দুজনকে নিয়ে। ফ্যাশনেবল সাজ ওর দখলে নেই। প'রে এসেছে জামা আর ধুতি, ধোবার বাড়িথেকে নতুন কাচিয়ে আনা, আর কাঁধে ঝুলছে একটা পাটকরা চাদর। এসে দেখে সভা বসেছে বাগানে। অজানা শৌখিন লোকের ভিড় । দমে গেল ওর সমস্ত মনটা, কোথাও লুকোতে পারলে বাঁচে। একটা কোণ নিয়ে বসবার চেষ্টা করতেই সবাই উঠে পড়ল। বললে, 'আসুন আসুন ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনার আসন এইখানে।'
একটা পিঠ-উঁচু মখমলে-মোড়া চৌকি, মণ্ডলীর ঠিক মাঝখানেই। বুঝতে পারলে সমস্ত জনতার প্রধান লক্ষ্যই ও। নীলা এসে ওর গলায় মালা পরিয়ে দিলে, কপালে দিলে চন্দনের ফোঁটা। ব্রজেন্দ্রবাবু প্রস্তাব করলেন ওকে জাগানী সভার সভাপতি পদে বরণ করা হোক। সমর্থন করলেন বঙ্কুবাবু, চারি দিকে করতালির ধ্বনি উঠল। সাহিত্যিক হরিদাসবাবু ডক্টর ভট্টাচার্যের ইণ্টারন্যাশনাল খ্যাতির কথা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, 'রেবতীবাবুর নামের পালে হাওয়া লাগিয়ে আমাদের জাগানী ক্লাবের তরণী খেয়া দেবে পশ্চিম-মহাসমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।'
সভার ব্যবস্থাপকেরা রিপোর্টারদের কানে কানে গিয়ে বললে, 'উপমাগুলোর কোনোটা যেন রিপোর্ট থেকে বাদ না যায়।'
বক্তারা একে একে উঠে যখন বলতে লাগল 'এতদিন পরে ডক্টর ভট্টাচার্য সায়েন্সের জয়তিলক ভারতমাতার কপালে পরিয়ে দিলেন', রেবতীর বুকটা ফুলে উঠল-- নিজেকে প্রকাশমান দেখলে সভ্যজগতের মধ্যগগনে। জাগানী সভা সম্বন্ধে যে-সমস্ত দাগী রকমের জনশ্রুতি শুনেছিল মনে মনে তার প্রতিবাদ করলে। হরিদাস বাবু যখন বললে, 'রেবতীবাবুর নামের কবচ রক্ষাকবচরূপে এ সভার গলায় আজ ঝোলানো হল, এর থেকে বোঝা যাবে এ সভার উদ্দেশ্য কত মহোচ্চ', তখন রেবতী নিজের নামের গৌরব ও দায়িত্ব খুব প্রবলরূপে অনুভব করলে। ওর মন থেকে সংকোচের খোলসটা খসে পড়ে গেল। মেয়েরা মুখের থেকে সিগারেট নামিয়ে ঝুঁকে পড়ল ওর চৌকির উপর, মধুর হাস্যে বললে, 'বিরক্ত করছি আপনাকে, কিন্তু একটা অটোগ্রাফ দিতেই হবে।'
রেবতীর মনে হলে, এতদিন সে যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিল, স্বপ্নের গুটি গেছে খুলে, প্রজাপতি বেরিয়ে পড়েছে।
একে একে লোক বিদায় হল। নীলা রেবতীর হাত চেপে ধরে বললে, 'আপনি কিন্তু যাবেন না।'
জ্বালাময় মদ ঢেলে দিলে ওর শিরার মধ্যে।
দিনের আলো শেষ হয়ে আসছে, লতাবিতানের মধ্যে সবুজ প্রদোষের অন্ধকার।
বেঞ্চির উপরে দুজনে কাছাকাছি বসল। নিজের হাতের উপরে রেবতীর হাত তুলে নিয়ে নীলা বললে, 'ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনি পুরুষমানুষ হয়ে মেয়েদের অত ভয় করেন কেন।'
রেবতীর স্পর্ধাভরে বললে, 'ভয় করি? কখনো না।'
'আমার মাকে আপনি ভয় করেন না?'
'ভয় কেন করব, শ্রদ্ধা করি!'
'আমাকে?'
'নিশ্চয় ভয় করি।'
'সেটা ভালো খবর। মা বলেছেন, কিছুতে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেননা। তা হলে আমি আত্মহত্যা করব!'
'কোনো বাধা আমি মানব না, আমাদের বিয়ে হবেই হবে।'
কাঁধের উপর মাথা রেখে নীলা বললে, 'তুমি হয়তো জান না, তোমাকে কতখানি চাই।'
নীলার মাথাটা আরো বুকের কাছে টেনে নিয়ে রেবতী বললে, 'তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।'
'জাত?'
'ভাসিয়ে দেব জাত'
'তা হলে রেজিস্ট্রারের কাছে কালই নোটিস দিতে হবে।'
'কালই দেব, নিশ্চয় দেব।'
রেবতী পুরুষের তেজ দেখাতে শুরু করেছে।
পরিণামটা দ্রুতবেগে ঘনিয়ে আসতে লাগল।
আইমার পক্ষাঘাতের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মৃত্যুর আশঙ্কা আসন্ন। যে পর্যন্ত মৃত্যু না হয় সোহিনীকে তিনি কিছুতে ছাড়বেন না। এই সুযোগটাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়িয়ে ধরে নীলার উন্মত্ত যৌবন আলোড়িত হয়ে উঠেছে।
পাণ্ডিত্যের চাপে রেবতীর পৌরুষের স্বাদ ফিকে হয়ে গেছে-- তাকে নীলার যথেষ্ট পছন্দ নয়। কিন্তু ওকে বিবাহ করা নিরাপদ, বিবাহোত্তর উচ্ছৃঙ্খলতায় বাধা দেবার জোর তার নেই। শুধু তাই নয়। ল্যাবরেটরির সঙ্গে যে লাভের বিষয় জড়ানো আছে তার পরিমাণ প্রভূত। ওর হিতৈষীরা বলে ল্যাবেরেটরির ভার নেবার যোগ্যতর পাত্র কোথাও মিলবে না রেবতীর চেয়ে; সোহিনী কিছুতে ওকে হাতছাড়া করবে না, এই হচ্ছে বুদ্ধিমানদের অনুমান।
এ দিকে সহযোগীদের ধিক্কার শিরোধার্য করে রেবতী জাগানী ক্লাবের অধ্যক্ষতার সংবাদ ঘোষণা করতে দিলে সংবাদপত্রে। নীলা যখন বলত, 'ভয় লাগছে বুঝি', ও বলত 'আমি কেয়ার করি নে'। ওর পৌরুষ সম্বন্ধে সংশয়মাত্র না থাকে এই জেদ ওকে পেয়ে বসল। বললে, 'এডিংটনের সঙ্গে চিঠিপত্র আমার চলে, একদিন এই ক্লাবে আমি তাঁকে নিমন্ত্রণ করে আনব', ক্লাবের মেম্বররা বললে 'ধন্য'।
রেবতীর আসল কাজ গেছে বন্ধ হয়ে। ছিন্ন হয়ে গেছে ওর সমস্ত চিন্তাসূত্র। মন কেবলই অপেক্ষা করছে নীলা কখন আসবে, হঠাৎ পিছন থেকে ধরবে ওর চোখ টিপে। চৌকির হাতার উপরে বসে বাঁ হাতে ধরবে ওর গলা জড়িয়ে। নিজেকে এই ব'লে আশ্বাস দিচ্ছে, ওর কাজটা যে বাধা পয়েছে সেটা ক্ষণিক, একটু সুস্থির হলেই ভাঙার মুখে আবার জোড়া লাগবে। সুস্থির হবার লক্ষণ আশু দেখা যাচ্ছে না। ওর কাজের ক্ষতিতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে নীলার মনের এক কোণেও সে শঙ্কা নেই, সমস্তটাকে সে প্রহসন মনে করে।
দিনের পর দিন জাল কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছে। জাগানী সভা ওকে ছেঁকে ধরেছে, ওকে ঘোরতর পুরুষমানুষ বানিয়ে তুলছে। এখনো অকথ্য মুখ থেকে বেরয় না, কিন্তু অশ্রাব্য শুনলে জোর করে হাসতে থাকে। ডক্টর ভট্টাচার্য ওদের খুব একটা মজার জিনিস হয়ে উঠেছে।
মাঝে মাঝে রেবতীকে ঈর্ষায় কামড়িয়ে ধরে। ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টরের মুখের চুরট থেকে নীলা চুরট ধরায়। এর নকল করা রেবতীর অসাধ্য। চুরটের ধোঁয়া গলায় গেলে ওর মাথা ঘুরে পড়ে, কিন্তু এই দৃশ্যটা ওর শরীরমনকে আরো অসুস্থ করে তোলে। তা ছাড়া নানারকমের ঠেলাঠেলি টানাটানি যখন চলতে থাকে, ও আপত্তি না জানিয়ে থাকতে পারে না। নীলা বলে, 'এই দেহটার 'পরে আমাদের তো কোনো মোহ নেই, আমাদের কাছে এর দাম কিসের-- আসল দামী জিনিস ভালোবাসা, সেটা কি বিলিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারি।' ব'লে চেপে ধরে রেবতীর হাত। রেবতী তখন অন্যদের অভাজন ব'লেই মনে করে, ভাবে ওরা ছোবড়া নিয়েই খুশি,শাঁসটা পেল না।
ল্যাবরেটরির দ্বারের বাইরে দিনরাত পাহারা চলছে, ভিতরে ভাঙা কাজ পড়ে রয়েছে, কারো দেখা নেই।

১৩

ড্রয়িংরুমে সোফায় পা দুটো তুলে কুশনে হেলান দিয়ে নীলা, মেঝের উপরে নীলার পায়ের কাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে রেবতী, হাতে রয়েছে লেখন-ভরা ফুলস্ক্যাপ।
রেবতী মাথা নেড়ে বললে, 'ভাষায় কেমন যেন বেশি রঙ ফলানো এতটা বাড়িয়ে-বলা লেখা পড়তে লজ্জা করবে আমার।'
'ভাষার তুমি মস্ত সমজদার কিনা। এ তো কেমিষ্ট্রি ফরমুলা নয়, খুঁত খুঁত কোরো না, মুখস্থ করে যাও। জান এটা লিখেছেন আমাদের সাহিত্যিক প্রমদারঞ্জনবাবু?'
'ঐ-সব মস্ত মস্ত সেণ্টেন্স আর বড়ো বড়ো শব্দগুলো মুখস্থ করা আমার পক্ষে ভারি শক্ত হবে।'
'ভারি তো শক্ত। তোমার কানের কাছে আউড়ে আউড়ে আমার তো সমস্তটা মুখস্থ হয়ে গেছে-- 'আমার জীবনের সর্বোত্তম শুভ মুহূর্তে জাগানী সভা আমাকে যে অমরাবতীর মন্দারমাল্যে সমলংকৃত করিলেন'-- গ্র্যাণ্ড! তোমার ভয় নেই আমি তো তোমার কাছেই থাকব, আস্তে আস্তে তোমাকে বলে দেব।'
'আমি বাংলাসাহিত্য ভালো জানি নে কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছে, সমস্ত লেখাটা যেন আমাকে ঠাট্টা করছে। ইংরেজিতে যদি বলতে দাও কত সহজ হয়। Dear friends, allow me to offer you my heartiest thanks for the honour you have conferred upon me on behalf of the Jagani Club-- the great Awakener ইত্যাদি। এমন দুটো সেণ্টেন্স বললেই বাস্‌--'
'সে হচ্ছে না, তোমার মুখে বাংলা যে খুব মজার শোনাবে-- ঐ যেখানটাতে আছে-- 'হে বাংলাদেশের তরুণসম্প্রদায়, হে স্বাতন্ত্রসঞ্চালনরথের সারথি, হে ছিন্ন-শৃঙ্খলপরিকীর্ণ পথের অগ্রণীবৃন্দ'-- যাই বল ইংরেজিতে এ কি হবার জো আছে। তোমার মতো বিজ্ঞানবিশারদের মুখে শুনলে তরুণ বাংলা সাপের মতো ফণা দুলিয়ে নাচবে। এখনো সময় আছে, আমি পড়িয়ে নিচ্ছি।' গুরুভার দীর্ঘ দেহকে সিঁড়ির উপর দিয়ে সশব্দে বহন ক'রে সাহেবী পোশাকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ব্রজেন্দ্র হালদার মচ্‌মচ্‌ শব্দে এসে উপস্থিত। বললে, 'নাঃ এ অসহ্য, যখনই আসি তখনই নীলাকে দখল করে বসে আছ। কাজ নেই , কর্ম নেই, নীলিকে তফাত করে রেখেছ আমাদের কাছ থেকে কাঁটাগাছের বেড়ার মতো।'
রেবতী সংকুচিত হয়ে বললে, 'আজ আমার একটু বিশেষ কাজ আছে তাই--'
'কাজ তো আছে, সেই ভরসাতেই তো এসেছিলুন; আজ তুমি মেম্বরদের নেমন্তন্ন করেছ, ব্যস্ত থাকবে মনে ক'রে আপিসে যাবার আগে আধ ঘণ্টাটাক সময় করে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসেছি। এসেই শুনেছি এখানেই উনি পড়েছেন কাজে বাঁধা। আশ্চর্য! কাজ না থাকলে এইখানেই ওঁর ছুটি, আবার কাজ থাকলে এইখানেই ওঁর কাজ। এমন নাছোড়বান্দার সঙ্গে আমরা কেজো লোকেরা পাল্লা দিই কী ক'রে। নীলি, is it fair।' নীলা বললে, 'ডক্টর ভট্‌চাজের দোষ হচ্ছে, উনি আসল কথাটা জোর করে বলতে পারেন না। উনি কাজ আছে বলে এসেছেন এটা বাজে কথা; না এসে থাকতে পারেন না বলেই এসেছেন, এটাই একটা শোনবার মতো কথা এবং সত্যি কথা। আমার সমস্ত সময় উনি দখল করেছেন ওঁর জেদের জোরে। এই তো ওঁর পৌরুষ। তোমাদের সবাইকে ঐ বাঙালের কাছে হার মানতে হল।'
'আচ্ছা ভালো, তা হলে আমাদেরও পৌরুষ চালাতে হবে। এখন থেকে জাগানীক্লাব-মেম্বররা নারীহরণের চর্চা শুরু করবে। জেগে উঠবে পৌরাণিক যুগ।'
নীলা বললে, 'বেশ মজা লাগছে শুনতে। নারীহরণ, পাণিগ্রহণের চেয়ে ভালো। কিন্তু পদ্ধতিটা কী রকম।'
হালদার বললে,'দেখিয়ে দিতে পারি।'
'এখনই?'
'হাঁ এখনই।'
বলেই সোফা থেকে নীলাকে আড়কোলা করে তুলে নিলে।
নীলা চিৎকার করে হেসে ওর গলা জড়িয়ে ধরলে।
রেবতীর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল, ওর মুশকিল এই যে অনুকরণ করবার কিংবা বাধা দেবার মতো গায়ের জোর নেই। ওর বেশি করে রাগ হতে লাগল নীলার 'পরে, এই-সব অসভ্য গোঁয়ারদের প্রশ্রয় দেয় কেন।
হালদার বললে 'গাড়ি তৈরি আছে। তোমাকে নিয়ে চললুম ডায়মণ্ডহারবারে। আজ সন্ধের ভোজে ফিরিয়ে এনে দেব। ব্যাঙ্কে কাজ ছিল, সেটা যাক গে চুলোয়। একটা সৎকার্য করা হবে। ডাক্তার ভট্‌চাজকে নির্জনে কাজ করবার সুবিধে করে দিচ্ছি। তোমার মতো অতবড়ো ব্যাঘাতকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো, এজন্যে উনি আমাকে ধন্যবাদ দেবেন।'
রেবতী দেখলে, নীলার ছট্‌ফট্‌ করবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, নিজেকে সে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টামাত্র করলে না, বেশ যেন আরামে ওর বক্ষ আশ্রয় করে রইল। ওর গলা জড়িয়ে রইল বিশেষ একটা আসক্তভাবে। যেতে যেতে বললে, 'ভয় নেই বিজ্ঞানী সাহেব, এটা নারীহরণের রিহর্সলমাত্র-- লঙ্কাপারে যাচ্ছি নে, ফিরে আসব তোমার নেমন্তন্নে।'
রেবতী ছিঁড়ে ফেললে সেই লেখাটা। হালদারের বাহুর জোর এবং অসংকুচিত অধিকার-বিস্তারের তুলনায় নিজের বিদ্যাভিমান ওর কাছে আজ বৃথা হয়ে গেল।
আজ সান্ধ্যভোজ একটা নামজাদা রেস্তোরাঁতে। নিমন্ত্রণকর্তা স্বয়ং রেবতী ভট্টাচার্য, তাঁর সম্মানিতা পার্শ্ববর্তিনী নীলা। সিনেমার বিখ্যাত নটী এসেছে গান গাইতে। টোস্ট প্রোপোজ করতে উঠেছে বঙ্কুবিহারী, গুণগান হচ্ছে রেবতীর আর তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে নীলার। মেয়েরা খুব জোরের সঙ্গে সিগারেট টানছে প্রমাণ করতে যে তারা সম্পূর্ণ মেয়ে নয়। প্রৌঢ়া মেয়েরা যৌবনের মুখোশ পরে ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে অট্টহাস্যে উচ্চকণ্ঠে পরস্পর গা-টেপাটেপিতে যুবতীদের ছাড়িয়ে যাবার জন্যে মাতামাতির ঘোড়দৌড় চালিয়েছে।
হঠাৎ ঘরে ঢুকল সোহিনী। স্তব্ধ হয়ে গেল ঘরসুদ্ধ সবাই। রেবতীর দিকে তাকিয়ে সোহিনী বললে, 'চিনতে পারছি নে। ডক্টর ভট্টাচার্য বুঝি? খরচের টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিলে, পাঠিয়ে দিয়েছি গেল শুক্রবারে; এই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিছু অকুলোন হচ্ছে না। এখন একবার উঠতে হচ্ছে, আজ রাত্রেই ল্যাবরেটরির ফর্দ অনুসারে জিনিসপত্র মিলিয়ে দেখব।'
'আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?'
'এতদিন অবিশ্বাস তো করি নি। কিন্তু লজ্জাশরম যদি থাকে বিশ্বাসরক্ষার কথা তুমি আর মুখে এনো না।'
রেবতী উঠতে যাচ্ছিল, নীলা তাকে কাপড় ধরে টেনে বসিয়ে দিলে। বললে, 'আজ উনি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন, সকলে যান আগে, তার পরে উনি যাবেন।'
এর মধ্যে একটা নিষ্ঠুর ঠোকর ছিল। সার আইজাক মায়ের বড়ো পেয়ারের। ওর মতো এতবড়ো বিশ্বাসী আর কেউ নেই, তাই সকলকে ছাড়িয়ে ল্যাবরেটরির ভার ওর উপরেই। আরো একটু দেগে দেবার জন্যে বললে, 'জান মা? অতিথি আজ পঁয়ষট্টি জন, এ ঘরে সকলকে ধরে নি, এক দল আছে পাশের ঘরে-- ঐ শুনছ না হো হো লাগিয়েছে? মাথা-পিছু পঁচিশ টাকা ধরে নেয়, মদ না খেলেও মদের দাম ধরে দিতে হয়। খালি গেলাসের জরিমানা কম লাগল না। আর কেউ হলে মুখ চুপসে যেত। ওঁর দরাজ হাত দেখে ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরের তাক লেগে গেছে। সিনেমার গাইয়েকে কত দিতে হয়েছে জান?-- তার এক রাত্তিরের পাওনা চারশো টাকা।'
রেবতীর মনের ভিতরটা কাটা কইমাছের মতো ধড়্‌ফড়্‌ করছে; শুকনো মুখে কথাটি নেই।
সোহিনী জিজ্ঞাসা করলে, 'আজকের সমারোহটা কিসের জন্যে।'
'তা জান না বুঝি? অ৻াসোসিয়েটেড প্রেসে তো বেরিয়ে গেছে, উনি জাগানী ক্লাবের প্রেসিডেণ্ট হয়েছেন, তারই সম্মানে এই ভোজ। লাইফ মেম্বরশিপের ছশো টাকা সুবিধেমত পরে শুধে দেবেন।'
'সুবিধে বোধ হয় শীঘ্র হবে না।'
রেবতীর মনটার মধ্যে স্টীমরোলার চলাচল করছিল।
সোহিনী তাকে জিজ্ঞাসা করলে, 'তা হলে এখন তোমার ওঠবার সুবিধে হবে না।'
রেবতী নীলার মুখের দিকে তাকালে। তার কুটিল কটাক্ষের খোঁচায় পুরুষমানুষের অভিমান জেগে উঠল। বললে, 'কেমন করে যাই, নিমন্ত্রিতেরা সব--'
সোহিনী বললে, 'আচ্ছা, আমি ততক্ষণ এখানে বসে রইলুম। নাসেরউল্লা , তুমি দরজার কাছে হাজির থাকো।'
নীলা বললে, 'সে হতে পারবে না, মা। আমাদের একটা গোপন পরামর্শ আছে, এখানে তোমার থাকা উচিত হবে না।'
'দেখ্‌ নীলা, চাতুরীর পালা তুই সবে শুরু করেছিস, এখনো আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবি নে। তোদের কিসের পরামর্শ সে খবর কি আমি পাই নি। বলে দিচ্ছি, তোদের সেই পরামর্শের জন্যে আমারই থাকা সব চেয়ে দরকার।'
নীলা বললে, 'তুমি কী শুনেছ, কার কাছে।'
'খবর নেবার ফন্দি থাকে গর্তর সাপের মতো টাকার থলির মধ্যে। এখানে তিনজন আইনওয়ালা মিলে দলিলপত্র ঘেঁটে বের করতে চাও ল্যাবরেটরি ফণ্ডে কোনো ছিদ্র আছে কিনা। তাই নয় কি, নীলু।'
নীলা বললে, 'তা সত্যি কথা বলব। বাবার অতখানি টাকায় তাঁর মেয়ের কোনো শেয়ার থাকবে না, এটা অস্বাভাবিক। তাই সবাই সন্দেহ করে--' সোহিনী চৌকি থেকে উঠে দাঁড়াল। বললে, 'আসল সন্দেহের মূল আরো অনেক আগেকার দিনের। কে তোর বাপ, কার সম্পত্তির শেয়ার চাস। এমন লোকের তুই মেয়ে এ কথা মুখে আনতে তোর লজ্জা করে না?'
নীলা লাফিয়ে উঠে বললে, 'কী বলছ, মা।'
'সত্যি কথা বলছি। তাঁর কাছে কিছুই গোপন ছিল না, তিনি জানতেন সব। আমার কাছে যা পাবার তা তিনি সম্পূর্ণ পেয়েছেন, আজও পাবেন তা, আর-কিছু তিনি গ্রাহ্য করেন নি।'
ব্যারিস্টর ঘোষ বললে, 'আপনার মুখের কথা তো প্রমাণ নয়।'
'সে কথা তিনি জানতেন। সকল কথা খোলসা করে তিনি দলিল রেজেস্ট্রি করে গেছেন।'
'ওহে বঙ্কু, রাত হল যে, আর কেন। চলো।'
পেশোয়ারীর ভঙ্গি দেখে পঁয়ষট্টি জন অন্তর্ধান করলে।
এমন সময় সুটকেস হাতে এসে উপস্থিত চৌধুরী। বললেন, 'তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে আসতে হল। কী রে রেবি, বেবি, মুখখানা যে পার্চমেণ্টের মতো সাদা হয়ে গেছে। ওরে, খোকার দুধের বাটি গেল কোথায়।'
নীলাকে দেখিয়ে সোহিনী বললে, 'যিনি জোগাবেন তিনি যে ঐ বসে আছেন।'
'গয়লানীর ব্যবসা ধরেছ নাকি, মা'
'গয়লা ধরার ব্যবসা ধরেছে, ঐ যে বসে আছে শিকারটি।'
'কে, আমাদের রেবি নাকি।'
'এইবার আমার মেয়ে আমার ল্যাবরেটরিকে বাঁচিয়েছে। আমি লোক চিনতে পারি নি; কিন্তু আমার মেয়ে ঠিক বুঝেছিল যে ল্যাবরেটরিতে গোয়ালঘর বসিয়ে দিয়েছিলুম--গোবরের কুণ্ডে আর-একটু হলেই ডুবত সমস্ত জিনিসটা।'
অধ্যাপক বললেন, 'মা, তুমি এই জীবটিকে আবিষ্কার করেছ যখন, তখন এই গোষ্ঠবিহারীর ভার তোমাকেই নিতে হবে। ওর আর সবই আছে কেবল বুদ্ধি নেই, তুমি কাছে থাকলে তার অভাবটা টের পাওয়া যাবে না। বোকা পুরুষদের নাকে দড়ি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে বেড়ানো সহজ ।'
নীলা বললে, 'কী গো সার আইজাক নিউটন, রেজিস্ট্রি আপিসে নোটিস তো দেওয়া হয়েছে, ফিরিয়ে নিতে চাও নাকি।'
বুক ফুলিয়ে রেবতী বললে, 'মরে গেলেও না।'
'বিয়েটা হবে তা হলে অশুভ লগ্নে।'
'হবেই, নিশ্চয় হবে।'
সোহিনী বললে, 'কিন্তু ল্যাবরেটরি থেকে শত হস্ত দূরে।'
অধ্যাপক বললেন, 'মা নীলু, ও বোকা, কিন্তু অক্ষম নয়। ওর নেশাটা কেটে যাক, তার পরে ওর খোরাকের জন্যে বেশি ভাবতে হবে না।' 'সার আইজাক, তা হলে কিন্তু তোমার কাপড়চোপড়গুলো একটু ভদ্র রকমের বানাতে হবে, নইলে তোমার সামনে আমাকে আবার ঘোমটা ধরতে হবে।'
হঠাৎ আর-একটা ছায়া পড়ল দেয়ালে। পিসিমা এসে দাঁড়ালেন। বললেন, 'রেবি, চলে আয়।'
সুড়্‌ সুড়্‌ করে রেবতী পিসিমার পিছন পিছন চলে গেল, একবার ফিরেও তাকাল না।
সং গ্রহ

Friday, January 24, 2014

অচলায়তন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


অচলায়তনের গৃহ
গান
পঞ্চক।
তুমি       ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে
কেউ তা জানে না,
আমার     মন যে কাঁদে আপন-মনে,
কেউ তা মানে না।
ফিরি আমি উদাস-প্রাণে,
তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতন এমন টানে
কেউ তো টানে না।
মহাপঞ্চকের প্রবেশ
মহাপঞ্চক। গান! আবার গান!
পঞ্চক। দাদা, তুমি তো দেখলে—তোমাদের এখানকার মন্ত্র-তন্ত্র আচার-আচমন সূত্র-বৃত্তি কিছুই পারলুম না।
মহাপঞ্চক। সে তো দেখতে বাকি নেই—কিন্তু সেটা কি খুব আনন্দ করবার বিষয়? তাই নিয়ে কি গলা ছেড়ে গান গাইতে হবে?
পঞ্চক। একমাত্র ঐটেই যে পারি।
মহাপঞ্চক। পারি! ভারি অহংকার। গান তো পাখিও গাইতে পারে। সেই যে বজ্রবিদারণ-মন্ত্রটা আজ সাত দিন ধরে তোমার মুখস্থ হল না, আজ তার কী করলে?
পঞ্চক। সাত দিন যেমন হয়েছে অষ্টম দিনেও অনেকটা সেইরকম। বরঞ্চ একটু খারাপ।
মহাপঞ্চক। খারাপ! তার মানে কী হল?
পঞ্চক। জিনিসটা যতই পুরোনো হচ্ছে মন ততই লাগছে না, ভুল ততই করছি—ভুল যতই বেশি বার করছি ততই সেইটেই পাকা হয়ে যাচ্ছে। তাই, গোড়ায় তোমরা যেটা বলে দিয়েছিলে আর আজ আমি যেটা আওড়াচ্ছি, দুটোর মধ্যে অনেকটা তফাত হয়ে গেছে। চেনা শক্ত।
মহাপঞ্চক। সেই তফাতটা ঘোচাতে হবে নির্বোধ।
পঞ্চক। সহজেই ঘোচে যদি তোমাদেরটাকেই আমার মতো করে নাও। নইলে আমি তো পারব না।
মহাপঞ্চক। পারবে না কী! পারতেই হবে।
পঞ্চক। তা হলে আর-একবার সেই গোড়া থেকে চেষ্টা করে দেখি—একবার মন্ত্রটা আউড়ে দিয়ে যাও।
মহাপঞ্চক। আচ্ছা বেশ, আমার সঙ্গে আবৃত্তি করে যাও। ওঁ তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয় ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয় স্বর বসত্ত্বানি। চুপ করে রইলে যে!
পঞ্চক। ওঁ তট তট তোতয় তোতয় —আচ্ছা দাদা।
মহাপঞ্চক। আবার দাদা। মন্ত্রটা শেষ করো বলছি।
পঞ্চক। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি —এ মন্ত্রটার ফল কী?
মহাপঞ্চক। এ মন্ত্র প্রত্যহ সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে উনসত্তর বার করে জপ করলে নব্বই বৎসর পরমায়ু হয়।
পঞ্চক। রক্ষা করো দাদা। এটা জপ করতে গিয়ে আমার এক বেলাকেই নব্বই বছর মনে হয়—দ্বিতীয় বেলায় মনে হয় মরেই গেছি।
মহাপঞ্চক। আমার ভাই হয়েও তোমার এই দশা! তোমার জন্যে আমাদের এই অচলায়তনের সকলের কাছে কি আমার কম লজ্জা!
পঞ্চক। লজ্জার তো কোনো কারণ নেই দাদা।
মহাপঞ্চক। কারণ নেই?
পঞ্চক। না। তোমার পাণ্ডিত্যে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি আশ্চর্য হয় তুমি আমারই দাদা বলে।
মহাপঞ্চক। এই বানরটার উপর রাগ করাও শক্ত। দেখো পঞ্চক, তুমি তো আর বালক নও—তোমার এখন বিচার করে দেখবার বয়স হয়েছে।
পঞ্চক। তাই তো বিপদে পড়েছি। আমি যা বিচার করি তোমাদের বিচার একেবারে তার উলটো দিকে চলে, অথচ তার জন্যে যা দণ্ড সে আমাকে একলাই ভোগ করতে হয়।
মহাপঞ্চক। পিতার মৃত্যুর পর কী দরিদ্র হয়ে, সকলের কী অবজ্ঞা নিয়েই এই আয়তনে আমরা প্রবেশ করেছিলুম, আর আজ কেবল নিজের শক্তিতে সেই অবজ্ঞা কাটিয়ে কত উপরে উঠেছি—আমার এই দৃষ্টান্তও কি তোমাকে একটু সচেষ্ট করে না ?
পঞ্চক। সচেষ্ট করবার তো কথা নয়। তুমি যে নিজগুণেই দৃষ্টান্ত হয়ে বসে আছ, ওর মধ্যে আমার চেষ্টার তো কিছুমাত্র দরকার হয় না। তাই নিশ্চিন্ত আছি।
মহাপঞ্চক। ঐ শঙ্খ বাজল। এখন আমার সপ্তকুমারিকাগাথা পাঠের সময়। কিন্তু বলে যাচ্ছি, সময় নষ্ট কোরো না।
[ প্রস্থান
গান
পঞ্চক।                                           
 বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর,
কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হতে দুয়ারে কর
    কেউ তো হানে না।
আকাশে কার ব্যাকুলতা,
বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা
    কেউ তো আনে না।
তুমি     ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে
    কেউ তা জানে না।।
ছাত্রদলের প্রবেশ
প্রথম ছাত্র। ওহে পঞ্চক।
পঞ্চক। না ভাই, আমাকে বিরক্ত কোরো না।
দ্বিতীয় ছাত্র। কেন? হল কী তোমার?
পঞ্চক। ওঁ তট তট তোতয় তোতয়—
তৃতীয় ছাত্র। এখনো তট তট তোতয় তোতয় ঘুচল না? ও যে আমাদের কোন্ কালে শেষ হয়ে গেছে তা মনেও আনতে পারি নে।
প্রথম ছাত্র। না ভাই, পঞ্চককে একটু পড়তে দাও; নইলে ওর কী গতি হবে! এখনো ও বেচারা তট তট করে মরছে—আমাদের যে ধ্বজাগ্রকেয়ূরী পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে!
দ্বিতীয় ছাত্র। আচ্ছা পঞ্চক, এখনো তুমি চক্রেশমন্ত্র শেখ নি?
পঞ্চক। না।
তৃতীয় ছাত্র। মরীচি?
পঞ্চক। না।
প্রথম ছাত্র। মহামরীচি?
পঞ্চক। না।
দ্বিতীয় ছাত্র। পর্ণশবরী?
পঞ্চক। না।
দ্বিতীয় ছাত্র। আচ্ছা বলো দেখি, হরেত-পক্ষীর নখাগ্রে যে পরিমাণ ধূলিকণা লাগে সেই পরিমাণ যদি –
পঞ্চক। আরে ভাই, হরেত-পক্ষীই কোনো জন্মে দেখি নি তো তার নখাগ্রের ধূলিকণা!
প্রথম ছাত্র। হরেত-পক্ষী তো আমরাও কেউ দেখি নি। শুনেছি, সে দধিসমুদ্রের পারে মহাজম্বুদ্বীপে বাস করে। কিন্তু এ-সমস্ত তো জানা চাই, নিতান্ত মূর্খ হয়ে জীবনটাকে মাটি করলে তো চলবে না।
দ্বিতীয় ছাত্র। পঞ্চক, তুমি আর বৃথা সময় নষ্ট কোরো না। তোমার কাছে তো কেউ বেশি আশা করে না। অন্তত শৃঙ্গভেরিব্রত, কাকচঞ্চুপরীক্ষা, ছাগলোমশোধন, দ্বাবিংশপিশাচভয়ভঞ্জন—এগুলো তো জানা চাইই; নইলে তুমি অচলায়তনের ছাত্র বলে লোকসমাজে পরিচয় দেবে কোন্ লজ্জায়?
তৃতীয় ছাত্র। চলো বিশ্বম্ভর, আমরা যাই। ও একটু পড়ুক।
গমনোদ্যত
পঞ্চক। ওহে বিশ্বম্ভর। তট তট তোতয় তোতয়—
বিশ্বম্ভর। কেন। আবার ডাকো কেন?
পঞ্চক। সঞ্জীব, জয়োত্তম, তট তট তোতয় তোতয়—
সঞ্জীব। কী হয়েছে? পড়ো-না!
পঞ্চক। দোহাই তোমাদের, একেবারে চলে যেয়ো না। ঐ শব্দগুলো আওড়াতে আওড়াতে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমান জীবের মুখ দেখলে তবু আশ্বাস হয় যে, জগৎটা বিধাতাপুরুষের প্রলাপ নয়।
জয়োত্তম। না হে, মহাপঞ্চক বড়ো রাগ করেন। তিনি মনে করেন, তোমার যে কিছু হচ্ছে না তার কারণ আমরা।
পঞ্চক। আমি যে কারও কোনো সাহায্য না নিয়ে কেবলমাত্র নিজগুণেই অকৃতার্থ হতে পারি, দাদা আমার এটুকু ক্ষমতাও স্বীকার করেন না, এতেই আমি বড়ো দুঃখিত হই। আচ্ছা ভাই, তোমরা ঐখানে একটু তফাতে বসে কথাবার্তা কও। যদি দেখ একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, আমাকে সতর্ক করে দিয়ো। স্ফট স্ফট স্ফোটয় স্ফোটয় –
জয়োত্তম। আচ্ছা বেশ, এইখানে আমরা বসছি।
সঞ্জীব। বিশ্বম্ভর, তুমি যে বললে এবার আমাদের আয়তনে গুরু আসবেন, সেটা শুনলে কার কাছ থেকে?
বিশ্বম্ভর। কী জানি, কারা সব বলা-কওয়া করছিল। কেমন করে চারি দিকেই রটে গিয়েছে যে, চাতুর্মাস্যের সময় গুরু আসবেন।
পঞ্চক। ওহে বিশ্বম্ভর, বল কী? আমাদের গুরু আসবেন নাকি?
সঞ্জীব। আবার পঞ্চক! তোমার কাজ তুমি করো-না।
পঞ্চক। ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়-
জয়োত্তম। কিন্তু অধ্যাপকদের কারও কাছে শুনেছ কি? মহাপঞ্চক কী বলেন?
বিশ্বম্ভর। তাঁকে জিজ্ঞাসা করাই বৃথা। মহাপঞ্চক কারও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করেন না। আজকাল তিনি আর্যঅষ্টোত্তরশত নিয়ে পড়েছেন—তাঁর কাছে ঘেঁষে কে!
পঞ্চক। চলো-না ভাই, আচার্যদেবের কাছে যাই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই—
জয়োত্তম। আবার! ফের!
পঞ্চক। ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়—
জয়োত্তম। আমার তো উনিশ বছর বয়স হল—এর মধ্যে একবারও আমাদের গুরু এ আয়তনে আসেন নি। আজ তিনি হঠাৎ আসতে যাবেন এটা বিশ্বাস করতে পারি নে।
সঞ্জীব। তোমার তর্কটা কেমনতরো হলো হে জয়োত্তম? উনিশ বছর আসেন নি বলে বিশ বছরে আসাটা অসম্ভব হল কোন্ যুক্তিতে?
বিশ্বম্ভর। তা হলে অঙ্কশাস্ত্রটাই অপ্রমাণ হয়ে যায়। তবে তো উনিশ পর্যন্ত বিশ নেই বলে উনিশের পরেও বিশ থাকতে পারে না।
সঞ্জীব। শুধু অঙ্ক কেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাও টেঁকে না। কারণ, যা এ মুহূর্তে ঘটে নি তা ও মুহূর্তেই বা ঘটে কী করে।
জয়োত্তম। আরে, ঐটেই তো আমার তর্ক। কে বললে ঘটে? যা পূর্বে ঘটে নি তা কিছুতেই পরে ঘটতে পারে না। আচ্ছা, এসো, কিছু যে ঘটে সেইটে প্রমাণ করে দাও।
পঞ্চক। (জয়োত্তমের কাঁধে চড়িয়া) প্রমাণ? এই দেখো প্রমাণ। ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়-
জয়োত্তম। আঃ পঞ্চক! কর কী! নাবো বলছি —আঃ নাবো।
পঞ্চক। আমি যে তোমার কাঁধে চড়েছি সেটা প্রমাণ না করে দিলে আমি কিছুতেই নাবছি নে। ঘূণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয়—
মহাপঞ্চকের প্রবেশ
মহাপঞ্চক। পঞ্চক, তুমি বড়ো উৎপাত করছ।
পঞ্চক। দাদা, এরাই গোল করছিল। আমি আরও থামিয়ে দেবার জন্যেই এসেছি। তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট—
মহাপঞ্চক। তোমার নিজের কাজ অবহেলা করবার একটা উপলক্ষ জুটলেই তোমাকে সংবরণ করা অসম্ভব।
বিশ্বম্ভর। দেখুন, একটা জনশ্রুতি শুনতে পাচ্ছি, বর্ষার আরম্ভে আমাদের গুরু নাকি এখানে আসবেন।
মহাপঞ্চক। আসবেন কি না তা নিয়ে আন্দোলন না করে যদিই আসেন তার জন্যে প্রস্তুত হও।
পঞ্চক। তিনি যদি আসেন তিনিই প্রস্তুত হবেন। এ দিক থেকে আবার আমরাও প্রস্তুত হতে গেলে হয়তো মিথ্যে একটা গোলমাল হবে।
মহাপঞ্চক। ভারি বুদ্ধিমানের মতোই কথা বললে!
পঞ্চক। অন্নের গ্রাস যখন মুখের কাছে এগোয় তখন মুখ স্থির হয়ে সেটা গ্রহণ করে—এ তো সোজা কথা। আমার ভয় হয়, গুরু এসে হয়তো দেখবেন, আমরা যে দিক দিয়ে প্রস্তুত হতে গিয়েছি সে দিকটা উলটো। সেইজন্যে আমি কিছু করি নে।
মহাপঞ্চক। পঞ্চক, আবার তর্ক?
পঞ্চক। তর্ক করতে পারি নে বলে রাগ কর, আবার দেখি পারলেও রাগ!
মহাপঞ্চক। যাও তুমি।
পঞ্চক। যাচ্ছি, কিন্তু বলো-না, গুরু কি সত্যই আসবেন?
মহাপঞ্চক। তাঁর সময় হলেই তিনি আসবেন।
[ প্রস্থান
সঞ্জীব। মহাপঞ্চক কোনো কথার শেষ উত্তর দিয়েছেন এমন কখনোই শুনি নি।
জয়োত্তম। কোনো কথার শেষ উত্তর নেই বলেই দেন না। মূর্খ যারা তারাই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, যারা অল্প জানে তারাই জবাব দেয়; আর যারা বেশি জানে তারা জানে যে জবাব দেওয়া যায় না।
পঞ্চক। সেইজন্যেই উপাধ্যায়মশায় যখন শাস্ত্র থেকে প্রশ্ন করেন তোমরা জবাব দাও, কিন্তু আমি একেবারে মূক হয়ে থাকি।
জয়োত্তম। কিন্তু প্রশ্ন না করতেই যে কথাগুলো বল তাতেই—
পঞ্চক। হ্যাঁ, তাতেই আমার খ্যাতি রটে গেছে, নইলে কেউ আমাকে চিনতেই পারত না।
বিশ্বম্ভর। দেখো পঞ্চক, যদি গুরু আসেন তা হলে তোমার জন্যে আমাদের সকলকেই লজ্জা পেতে হবে।
সঞ্জীব। আটান্ন প্রকার আচমনবিধির মধ্যে পঞ্চক বড়োজোর পাঁচটা প্রকরণ এতদিনে শিখেছে।
পঞ্চক। সঞ্জীব, আমার মনে আঘাত দিও না। অত্যুক্তি করছ।
সঞ্জীব। অত্যুক্তি!
পঞ্চক। অত্যুক্তি নয় তো কী! তুমি বলছ পাঁচটা শিখেছি। আমি দুটোর বেশি একটাও শিখি নি। তৃতীয় প্রকরণে মধ্যমাঙ্গুলির কোন্ পর্বটা কতবার কতখানি জলে ডুবোতে হবে সেটা ঠিক করতে গিয়ে অন্য আঙুলের অস্তিত্বই ভুলে যাই। কেবল একমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটা আমার খুব অভ্যাস হয়ে গেছে। হাসছ কেন? বিশ্বাস করছ না বুঝি?
জয়োত্তম। বিশ্বাস করা শক্ত।
পঞ্চক। সেদিন উপাধ্যায়মশায় যখন পরীক্ষা করতে এলেন তখন তাঁকে ওই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পর্যন্ত দেখিয়ে বিস্মিত করবার চেষ্টায় ছিলুম, কিন্তু তিনি চোখ পাকিয়ে তর্জনী তুললেন, আমার আর এগোল না।
বিশ্বম্ভর। না পঞ্চক, এবার গুরু আসার জন্যে তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে।
পঞ্চক। পঞ্চক পৃথিবীতে যেমন অপ্রস্তুত হয়ে জন্মেছে তেমনি অপ্রস্তুত হয়েই মরবে; ওর ঐ একটি মহদ্গুণ আছে, ওর
কখনো বদল হয় না।
সঞ্জীব। তোমার সেই গুণে উপাধ্যায়মশায়কে যে মুগ্ধ করতে পেরেছ তা তো বোধ হয় না।
পঞ্চক। আমি তাঁকে কত বোঝাবার চেষ্টা করি যে, বিদ্যা সম্বন্ধে আমার একটুও নড়চড় নেই—ঐ যাকে বল ধ্রুবনক্ষত্র—তাতে সুবিধা এই যে, এখানকার ছাত্ররা কে কতদূর এগোল তা আমার সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যাবে।
জয়োত্তম। তোমার আশ্চর্য এই সুযুক্তিতে উপাধ্যায়মশায়ের বোধ হয়—
পঞ্চক। না, কিছু না —তাঁর মনে কিছুমাত্র বিকার ঘটল না। আমার সম্বন্ধে পূর্বে তাঁর যে ধারণা ছিল সেইটেই দেখলুম আরো পাকা হল।
সঞ্জীব। আমরা যদি উপাধ্যায়মশায়কে তোমার মতন অমন যা-তা বলতুম তা হলে রক্ষা থাকত না। কিন্তু পঞ্চকের বেলায়—
পঞ্চক। তার মানে আছে। কুতর্কটা আমার পক্ষে এমনি সুন্দর স্বাভাবিক যে, সেটা আমার মুখে ভারি মিষ্ট শোনায়। সকলেই খুশি হয়ে বলে, ঠিক হয়েছে, পঞ্চকের মতোই কথা হয়েছে। কিন্তু ঘোরতর বুদ্ধির পরিচয় না দিতে পারলে তোমাদের আদর নেই, এমনি তোমরা হতভাগ্য।
জয়োত্তম। যাও ভাই পঞ্চক, আর বোকো না। আমরা চললুম। তুমি একটু মন দিয়ে পড়ো।
[ তিনজনের প্রস্থান
পঞ্চক। হবে না, আমার কিছুই হবে না। এখানকার একটা মন্ত্রও আমার খাটল না।
গান
দূরে কোথায় দূরে দূরে
মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে
সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।
যে পথ সকল দেশ পারায়ে
উদাস হয়ে যায় হারায়ে,
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান
যেতে চায় কোন্ অচিন পুরে।
ও কী ও! কান্না শুনি যে! এ নিশ্চয়ই সুভদ্র। আমাদের এই আয়তনে ওর চোখের জল আর শুকোল না। ওর কান্না আমি সইতে পারি নে!
[ প্রস্থান
বালক সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের পুনঃপ্রবেশ
পঞ্চক। তোর কোনো ভয় নেই ভাই, কোনো ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল্, কী হয়েচে বল্।
সুভদ্র। আমি পাপ করেছি।
পঞ্চক। পাপ করেছিস? কী পাপ?
সুভদ্র। সে আমি বলতে পারব না! ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে!
পঞ্চক। তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল্।
সুভদ্র। আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের –
পঞ্চক। উত্তর দিকের?
সুভদ্র। হাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে—
পঞ্চক। জানলা খুলে কী করলি?
সুভদ্র। বাইরেটা দেখে ফেলেছি!
পঞ্চক। দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে!
সুভদ্র। হাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না—একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
পঞ্চক। ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে। আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তা হলে তার বারো-আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত; আমি আসার পর প্রায় তার সব-কটাই ব্যবহারে লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারি নি।
বালকদলের প্রবেশ
প্রথম বালক। অ্যাঁ, সুভদ্র! তুমি বুঝি এখানে?
দ্বিতীয় বালক। জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র কী ভয়ানক পাপ করেছে?
পঞ্চক। চুপ চুপ। ভয় নেই সুভদ্র। কাঁদছিস কেন ভাই। প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তো করবি। প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারি মজা। এখানে রোজই একঘেয়ে রকমের দিন কাটে, প্রায়শ্চিত্ত না থাকলে তো মানুষ টিকতেই পারত না।
প্রথম বালক। (চুপি চুপি) জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা—
পঞ্চক। আচ্ছা আচ্ছা, সুভদ্রের মতো তোদের অমন সাহস আছে?
দ্বিতীয় বালক। আমাদের আয়তনের উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর।
তৃতীয় বালক। সে দিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তা হলে যে সে –
পঞ্চক। তা হলে কী?
তৃতীয় বালক। সে যে ভয়ানক।
পঞ্চক। কী ভয়ানক, শুনিই-না।
তৃতীয় বালক। জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।
সুভদ্র। পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী হবে?
পঞ্চক। শোন্ বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে। কিন্তু যাই হোক-না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে।
সুভদ্র। ভয় কর না?
সকল ছেলে। ভয় কর না?
পঞ্চক। না। আমি তো বলি, দেখিই-না কী হয়।
সকলে। (কাছে ঘেঁষিয়া) আচ্ছা দাদা, তুমি বুঝি অনেক দেখেছ?
পঞ্চক। দেখেছি বৈকি। ও মাসে শনিবারে যেদিন মহাময়ূরী দেবীর পূজা পড়ল সেদিন আমি কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে তার উপর পাঁচটা শেয়ালকাঁটার পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে নিজে আঠারো বার ফুঁ দিয়েছি।
সকলে। অ্যাঁ! কী ভয়ানক! আঠারো বার!
সুভদ্র। পঞ্চকদাদা, তোমার কী হল।
পঞ্চক। তিনদিনের দিনে যে সাপটা এসে আমাকে নিশ্চয় কামড়াবে কথা ছিল সে আজ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করতে পারে নি।
প্রথম বালক। কিন্তু ভয়ানক পাপ করেছ তুমি।
দ্বিতীয় বালক। মহাময়ূরী দেবী ভয়ানক রাগ করেছেন।
পঞ্চক। তাঁর রাগটা কিরকম সেইটে দেখবার জন্যেই তো এ কাজ করেছি।
সুভদ্র। কিন্তু পঞ্চকদাদা, যদি তোমাকে সাপে কামড়াত।
পঞ্চক। তা হলে এ সম্বন্ধে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো সন্দেহ থাকত না।
প্রথম বালক। কিন্তু পঞ্চকদাদা, আমাদের উত্তর দিকের জানলাটা-
পঞ্চক। সেটাও আমাকে একবার খুলে দেখতে হবে স্থির করেছি।
সুভদ্র। তুমিও খুলে দেখবে?
পঞ্চক। হাঁ ভাই সুভদ্র, তা হলে তুই তোর দলের একজন পাবি।
প্রথম বালক। না পঞ্চকদাদা, পায়ে পড়ি পঞ্চকদাদা, তুমি—
পঞ্চক। কেন রে, তোদের তাতে ভয় কী?
দ্বিতীয় বালক। সে যে ভয়ানক।
পঞ্চক। ভয়ানক না হলে মজা কিসের?
তৃতীয় বালক। সে যে ভয়ানক পাপ।
প্রথম বালক। মহাপঞ্চকদাদা আমাদের বলে দিয়েছেন, ওতে মাতৃহত্যার পাপ হয়; কেননা উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর।
পঞ্চক। মাতৃহত্যা করলুম না অথচ মাতৃহত্যার পাপটা করলুম, সেই মজাটা কিরকম দেখতে আমার ভয়ানক কৌতূহল।
প্রথম বালক। তোমার ভয় করবে না?
পঞ্চক। কিছু না। ভাই সুভদ্র, তুই কী দেখলি বল্ দেখি।
দ্বিতীয় বালক। না না, বলিস নে।
তৃতীয় বালক। না, সে আমরা শুনতে পারব না—কী ভয়ানক!
প্রথম বালক। আচ্ছা, একটু, খুব একটুখানি বল্ ভাই।
সুভদ্র। আমি দেখলুম—সেখানে পাহাড়, গোরু চরছে—
বালকগণ। (কানে আঙুল দিয়া) ও বাবা! না না, আর শুনব না। আর বোলো না সুভদ্র। ওই যে উপাধ্যায়মশায় আসছেন। চল্ চল্—আর না।
পঞ্চক। কেন। এখন তোমাদের কী।
প্রথম বালক। বেশ, তাও জান না বুঝি। আজ যে পূর্বফাল্গুনী নক্ষত্র—
পঞ্চক। তাতে কী।
দ্বিতীয় বালক। আজ কাকিনী সরোবরের নৈর্ঋত-কোণে ঢোঁড়াসাপের খোলস খুঁজতে হবে না?
পঞ্চক। কেন রে।
প্রথম বালক। তুমি কিছু জান না পঞ্চকদাদা! সেই খোলস কালো রঙের ঘোড়ার লেজের সাতগাছি চুল দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ধোঁয়া করতে হবে যে।
দ্বিতীয় বালক। আজ যে পিতৃপুরুষেরা সেই ধোঁয়া ঘ্রাণ করতে আসবেন।
পঞ্চক। তাতে তাঁদের কষ্ট হবে না?
প্রথম বালক। পুণ্য হবে যে, ভয়ানক পুণ্য।

"মাসির বাড়ী কিশোরগঞ্জ মামার বাড়ী চাতলপাড়
বাপের বাড়ী বাওনবাইড়া নিজের বাড়ী নাই আমার"

উপাধ্যায়ের প্রবেশ
উপাধ্যায়। পঞ্চককে শিশুদের দলেই প্রায় দেখতে পাই।
পঞ্চক। এই আয়তনে ওদের সঙ্গেই আমার বুদ্ধির একটু মিল হয়। ওরা একটু বড়ো হলেই আর তখন—
উপাধ্যায়। কিন্তু তোমার সংসর্গে যে ওরা অসংযত হয়ে উঠছে। সেদিন পটুবর্ম আমার কাছে এসে নালিশ করেছে, শুক্রবারের প্রথম প্রহরেই উপতিষ্য তার গায়ের উপর হাই তুলে দিয়েছে।
পঞ্চক। তা দিয়েছে বটে। আমি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলুম।
উপাধ্যায়। সে আমি অনুমানেই বুঝেছি, নইলে এতবড়ো আয়ুক্ষয়কর অনিয়মটা ঘটবে কেন। শুনেছি, তুমি নাকি সকলের সাহস বাড়িয়ে দেবার জন্য পটুবর্মকে ডেকে তোমার গায়ের উপর এক শো বার হাই তুলতে বলেছিলে?
পঞ্চক। আপনি ভুল শুনেছেন।
উপাধ্যায়। ভুল শুনেছি?
পঞ্চক। একলা পটুবর্মকে নয়, সেখানে যত ছেলে ছিল প্রত্যেককেই আমার গায়ের উপর অন্তত দশটা করে হাই তুলে যাবার জন্যে ডেকেছিলুম—পক্ষপাত করি নি।
উপাধ্যায়। প্রত্যেককেই ডেকেছিলে?
পঞ্চক। প্রত্যেককেই। আপনি বরঞ্চ জিজ্ঞাসা করে জানবেন। কেউ সাহস করে এগোল না। তারা হিসেব করে দেখলে, পনেরো জন ছেলেতে মিলে দেড়শো হাই তুললে তাতে আমার সমস্ত আয়ু ক্ষয় হয়ে গিয়েও আরো অনেকটা বাকি থাকে, সেই উদ্বৃত্তটাকে নিয়ে যে কী হবে তাই স্থির করতে না পেরে তারা মহাপঞ্চকদাদাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে গেল, তাতেই তো আমি ধরা পড়ে গেছি।
উপাধ্যায়। দেখো, তুমি মহাপঞ্চকের ভাই বলে এতদিন অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু আর চলবে না। আমাদের গুরু আসছেন শুনেছ?
পঞ্চক। গুরু আসছেন? নিশ্চয় সংবাদ পেয়েছেন?
উপাধ্যায়। হাঁ। কিন্তু এতে তোমার উৎসাহের তো কোনো কারণ নেই।
পঞ্চক। আমারই তো গুরুর দরকার বেশি, আমার যে কিছুই শেখা হয় নি।
ভদ্রের প্রবেশ
সুভদ্র। উপাধ্যায়মশায়।
পঞ্চক। আরে, পালা পালা। উপাধ্যায়মশায়ের কাছ থেকে একটু পরমার্থতত্ত্ব শুনছি, এখন বিরক্ত করিস নে, একেবারে দৌড়ে পালা।
উপাধ্যায়। কী সুভদ্র, তোমার বক্তব্য কী শীঘ্র বলে যাও।
সুভদ্র। আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
পঞ্চক। ভারি পণ্ডিত কিনা! পাপ করেছি! পালা বলছি।
উপাধ্যায়। (উৎসাহিত হইয়া) ওকে তাড়া দিচ্ছ কেন। সুভদ্র, শুনে যাও।
পঞ্চক। আর রক্ষা নেই, পাপের একটুকু গন্ধ পেলে একেবারে মাছির মতো ছোটে।
উপাধ্যায়। কী বলছিলে?
সুভদ্র। আমি পাপ করেছি।
উপাধ্যায়। পাপ করেছ? আচ্ছা বেশ। তা হলে বোসো। শোনা যাক।
সুভদ্র। আমি আয়তনের উত্তর দিকের—
উপাধ্যায়। বলো, বলো, উত্তর দিকের দেওয়ালে আঁক কেটেছ?
সুভদ্র। না, আমি উত্তর দিকের জানলায়—
উপাধ্যায়। বুঝেছি, কুনুই ঠেকিয়েছ। তা হলে তো সেদিকে আমাদের যতগুলি যজ্ঞর পাত্র আছে সমস্তই ফেলা যাবে। সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ওই জানলা না চাটাতে পারলে শোধন হবে না।
পঞ্চক। এটা আপনি ভুল বলছেন। ক্রিয়াসংগ্রহে আছে ভূমিকুষ্মাণ্ডের বোঁটা দিয়ে একবার-
উপাধ্যায়। তোমার তো স্পর্ধা কম দেখি নে। কুলদত্তের ক্রিয়াসংগ্রহের অষ্টাদশ অধ্যায়টি কি কোনোদিন খুলে দেখা হয়েছে?
পঞ্চক। (জনান্তিকে) সুভদ্র, যাও তুমি।—কিন্তু কুলদত্তকে তো আমি—
উপাধ্যায়। কুলদত্তকে মান না? আচ্ছা, ভরদ্বাজ মিশ্রের প্রয়োগপ্রজ্ঞপ্তি তো মানতেই হবে— তাতে—
সুভদ্র। উপাধ্যায়মশায়, আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
পঞ্চক। আবার! সেই কথাই তো হচ্ছে। তুই চুপ কর্ ।
উপাধ্যায়। সুভদ্র, উত্তরে দেয়ালে যে আঁক কেটেছ সে চতুষ্কোণ, না গোলাকার?
সুভদ্র। আঁক কাটি নি। আমি জানলা খুলে বাইরে চেয়েছিলুম।
উপাধ্যায়। (বসিয়া পড়িয়া) আঃ সর্বনাশ! করেছিস কী! আজ তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর ঐ জানলা কেউ খোলে নি তা জানিস?
সুভদ্র। আমার কী হবে।
পঞ্চক। (সুভদ্রকে আলিঙ্গন করিয়া) তোমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশো-পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ। তোমার এই অসামান্য সাহস দেখে উপাধ্যায়মশায়ের মুখে আর কথা নেই।
[ সুভদ্রকে টানিয়া লইয়া প্রস্থান
উপাধ্যায়। জানি নে কী সর্বনাশ হবে। উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী যে একজটা দেবী। বালকের দুই চক্ষু মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। যাই, আচার্যদেবকে জানাই গে।
[প্রস্থান
আচার্য ও উপাচার্যের প্রবেশ
আচার্য। এতকাল পরে আমাদের গুরু আসছেন।
উপাচার্য। তিনি প্রসন্ন হয়েছেন।
আচার্য। প্রসন্ন হয়েছেন?
তা হবে। হয়তো প্রসন্নই হয়েছেন। কিন্তু কেমন করে জানব?
উপাচার্য। নইলে তিনি আসবেন কেন?
আচার্য। এক-এক সময়ে মনে ভয় হয় যে, হয়তো অপরাধের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে বলেই তিনি আসছেন।
উপাচার্য। না, আচার্যদেব, এমন কথা বলবেন না। আমরা কঠোর নিয়ম সমস্তই নিঃশেষে পালন করেছি —কোনো ত্রুটি ঘটে নি।
আচার্য। কঠোর নিয়ম? হাঁ, সমস্তই পালিত হয়েছে।
উপাচার্য। বজ্রশুদ্ধিব্রত আমাদের আয়তনে এইবার নিয়ে ঠিক সাতাত্তর বার পূর্ণ হয়েছে। আর কোনো আয়তনে এ কি সম্ভবপর হয়।
আচার্য। না, আর কোথাও হতে পারে না।
উপাচার্য। কিন্তু তবু আপনার মনে এমন দ্বিধা হচ্ছে কেন।
আচার্য। দ্বিধা? তা দ্বিধা হচ্ছে সে কথা স্বীকার করি। (কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া) দেখো সূতসোম, অনেক দিন থেকে মনের মধ্যে বেদনা জেগে উঠছে, কাউকে বলতে পারছি নে। আমি এই আয়তনের আচার্য; আমার মনকে যখন কোনো সংশয় বিদ্ধ করতে থাকে তখন একলা চুপ করে বহন করতে হয়। এতদিন তাই বহন করে এসেছি। কিন্তু যেদিন পত্র পেয়েছি গুরু আসছেন সেই দিন থেকে মনকে আর যেন চুপ করিয়ে রাখতে পারছি নে। সে কেবলই আমাদের প্রতিদিনের সকল কাজেই বলে বলে উঠছে—বৃথা, বৃথা, সমস্তই বৃথা।
উপাচার্য। আচার্যদেব, বলেন কী। বৃথা, সমস্তই বৃথা?
আচার্য। সূতসোম, আমরা এখানে কতদিন হল এসেছি মনে পড়ে কি? কত বছর হবে?
উপাচার্য। সময় ঠিক করে বলা বড়ো কঠিন। এখানে মনের পক্ষে প্রাচীন হয়ে উঠতে বয়সের দরকার হয় না। আমার তো মনে হয় আমি জন্মের বহু পূর্ব হতেই এখানে স্থির হয়ে বসে আছি।
আচার্য। দেখো সূতসোম, প্রথম যখন এখানে সাধনা আরম্ভ করেছিলুম তখন নবীন বয়স, তখন আশা ছিল সাধনার শেষে একটা-কিছু পাওয়া যাবে। সেইজন্যে সাধনা যতই কঠিন হচ্ছিল উৎসাহ আরো বেড়ে উঠছিল। তার পরে সেই সাধনার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একেবারেই ভুলে বসেছিলুম যে, সিদ্ধি বলে কিছু-একটা আছে। আজ গুরু আসবেন শুনে হঠাৎ মনটা থমকে দাঁড়াল—আজ নিজেকে জিজ্ঞাসা করলুম, ওরে পণ্ডিত, তোর সব শাস্ত্রই তো পড়া হল, সব ব্রতই তো পালন করলি, এখন বল্ মূর্খ, কী পেয়েছিস। কিছু না কিছু না, সূতসোম। আজ দেখছি—এই অতিদীর্ঘকালের সাধনা কেবল আপনাকেই আপনি প্রদক্ষিণ করেছে— কেবল প্রতিদিনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি রাশীকৃত হয়ে জমে উঠেছে।
উপাচার্য। বোলো না, বোলো না, এমন কথা বোলো না। আচার্যদেব, আজ কেন হঠাৎ তোমার মন এত উদ্ভ্রান্ত হল!
আচার্য। সূতসোম, তোমার মনে কি তুমি শান্তি পেয়েছ?
উপাচার্য। আমার তো একমুহূর্তের জন্যে অশান্তি নেই।
আচার্য। অশান্তি নেই?
উপাচার্য। কিছুমাত্র না। আমার অহোরাত্র একেবারে নিয়মে বাঁধা। সে হাজার বছরের বাঁধন। ক্রমেই সে পাথরের মতো বজ্রের মতো শক্ত হয়ে জমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যেও কিছু ভাবতে হয় না। এর চেয়ে আর শান্তি কী হতে পারে?
আচার্য। না না, তবে আমি ভুল করছিলুম সূতসোম, ভুল করছিলুম। যা আছে এই ঠিক, এইই ঠিক। যে করেই হোক এর মধ্যে শান্তি পেতেই হবে।
উপাচার্য। সেইজন্যেই তো অচলায়তন ছেড়ে আমাদের কোথাও বেরোনো নিষেধ। তাতে যে মনের বিক্ষেপ ঘটে —শান্তি চলে যায়।
আচার্য। ঠিক, ঠিক —ঠিক বলেছ সূতসোম। অচেনার মধ্যে গিয়ে কোথায় তার অন্ত পাব? এখানে সমস্তই জানা, সমস্তই অভ্যস্ত—এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায়—তার জন্যে একটুও বাইরে যাবার দরকার হয় না। এই তো নিশ্চল শান্তি। গুরু, তুমি যখন আসবে, কিছু সরিয়ো না, কিছু আঘাত কোরো না—চারি দিকেই আমাদের শান্তি, সেই বুঝে পা ফেলো। দয়া কোরো, দয়া কোরো আমাদের। আমাদের পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে, আমাদের আর চলবার শক্তি নেই। অনেক বৎসর অনেক যুগ যে এমনি করেই কেটে গেল—প্রাচীন, প্রাচীন, সমস্ত প্রাচীন হয়ে গেছে—আজ হঠাৎ বোলো না যে নূতনকে চাই—আমাদের আর সময় নেই।
উপাচার্য। আচার্যদেব, তোমাকে এমন বিচলিত হতে কখনো দেখি নি।
আচার্য। কী জানি, আমার কেমন মনে হচ্ছে কেবল একলা আমিই না, চারি দিকে সমস্তই বিচলিত হয়ে উঠেছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানকার দেয়ালের প্রত্যেক পাথরটা পর্যন্ত বিচলিত। তুমি এটা অনুভব করতে পারছ না সূতসোম?
উপাচার্য। কিছুমাত্র না। এখানকার অটল স্তব্ধতার লেশমাত্র বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি নে। আমাদের তো বিচলিত হবার কথাও না। আমাদের সমস্ত শিক্ষা কোন্ কালে সমাধা হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত।
আচার্য। আজ আমার একটু একটু মনে পড়ছে বহুপূর্বে সব প্রথমে সেই ভোরের বেলা অন্ধকার থাকতে থাকতে যাঁর কাছে শিক্ষা আরম্ভ করেছিলুম তিনি গুরুই—তিনি পুঁথি নন, শাস্ত্র নন, বৃত্তি নন, তিনি গুরু। তিনি যা ধরিয়ে দিলেন তাই নিয়ে আরম্ভ করলুম—এতদিন মনে করে নিশ্চিন্ত ছিলুম সেইটেই বুঝি আছে, ঠিক চলছে—কিন্তু—
উপাচার্য। ঠিক আছে, ঠিক চলছে আচার্যদেব, ভয় নেই। প্রভু, আমাদের এখানে সেই প্রথম উষার বিশুদ্ধ অন্ধকারকে হাজার বছরেও নষ্ট হতে দিই নি। তারই পবিত্র অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে আমরা আচার্য এবং ছাত্র, প্রবীণ এবং নবীন, সকলেই স্থির হয়ে বসে আছি। তুমি কি বলতে চাও এতদিন পরে কেউ এসে সেই আমাদের ছায়া নাড়িয়ে দিয়ে যাবে! সর্বনাশ! সেই ছায়া!
আচার্য। সর্বনাশই তো!
উপাচার্য। তা হলে হবে কী! এতদিন যারা স্তব্ধ হয়ে আছে তাদের কি আবার উঠতে হবে?
আচার্য। আমি তো তাই সামনে দেখছি। সে কি আমার স্বপ্ন! অথচ আমার তো মনে হচ্ছে এই-সমস্তই স্বপ্ন—এই পাথরের প্রাচীর, এই বন্ধ দরজা, এইসব নানা রেখার গণ্ডি, এই স্তূপাকার পুঁথি, এই অহোরাত্র মন্ত্রপাঠের গুঞ্জনধ্বনি—সমস্তই স্বপ্ন।
উপাচার্য। ওই-যে পঞ্চক আসছে। পাথরের মধ্যে কি ঘাস বেরোয়। এমন ছেলে আমাদের আয়তনে কী করে সম্ভব হল!
শিশুকাল থেকেই ওর ভিতর এমন-একটা প্রবল অনিয়ম আছে, তাকে কিছুতেই দমন করা গেল না। ঐ বালককে আমার ভয় হয়। ঐ আমাদের দুর্লক্ষণ। এই আয়তনের মধ্যে ও কেবল তোমাকেই মানে। তুমি ওকে একটু ভর্ৎসনা করে দিয়ো।
আচার্য। আচ্ছা, তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা কয়ে দেখি।
[ উপাচার্যের প্রস্থান
পঞ্চকের প্রবেশ
"মাসির বাড়ী কিশোরগঞ্জ মামার বাড়ী চাতলপাড়
বাপের বাড়ী বাওনবাইড়া নিজের বাড়ী নাই আমার"
আচার্য। (পঞ্চকের গায়ে হাত দিয়া) বৎস পঞ্চক!
পঞ্চক। করলেন কী! আমাকে ছুঁলেন?
আচার্য। কেন, বাধা কী আছে?
পঞ্চক। আমি যে আচার রক্ষা করতে পারি নি।
আচার্য। কেন পার নি বৎস?
পঞ্চক। প্রভু, কেন, তা আমি বলতে পারি নে। আমার পারবার উপায় নেই।
আচার্য। সৌম্য, তুমি তো জান, এখানকার যে নিয়ম সেই নিয়মকে আশ্রয় করে হাজার বছর হাজার হাজার লোক নিশ্চিন্ত আছে। আমরা যে খুশি তাকে কি ভাঙতে পারি?
পঞ্চক। আচার্যদেব, যে নিয়ম সত্য তাকে ভাঙতে না দিলে তার যে পরীক্ষা হয় না।
আচার্য। নিয়মের জন্য ভয় নয়, কিন্তু যে লোক ভাঙতে যাবে তারই বা দুর্গতি ঘটতে দেব কেন?
পঞ্চক। আমি কোনো তর্ক করব না। আপনি নিজমুখে যদি আদেশ করেন যে, আমাকে সমস্ত নিয়ম পালন করতেই হবে তা হলে পালন করব। আমি আচার-অনুষ্ঠান কিছুই জানি নে, আমি আপনাকেই জানি।
আচার্য। আদেশ করব—তোমাকে! সে আর আমার দ্বারা হয়ে উঠবে না।
পঞ্চক। কেন আদেশ করবেন না প্রভু।
আচার্য। কেন? বলব বৎস? তোমাকে যখন দেখি আমি মুক্তিকে যেন চোখে দেখতে পাই। এত চাপেও যখন দেখলুম তোমার মধ্যে প্রাণ কিছুতেই মরতে চায় না তখনই আমি প্রথম বুঝতে পারলুম মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য, হাজার বছরের অতিপ্রাচীন আচারের চেয়ে সত্য। যাও বৎস, তোমার পথে তুমি যাও। আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা কোরো না।
পঞ্চক। আচার্যদেব, আপনি জানেন না কিন্তু আপনিই আমাকে নিয়মের চাকার নীচে থেকে টেনে নিয়েছেন।
আচার্য। কেমন করে বৎস?
পঞ্চক। তা জানি নে, কিন্তু আপনি আমাকে এমন একটা-কিছু দিয়েছেন যা আচারের চেয়ে নিয়মের চেয়ে অনেক বেশি।
আচার্য। তুমি কী কর না কর আমি কোনোদিন জিজ্ঞাসা করি নে, কিন্তু আজ একটি কথা জিজ্ঞাসা করব। তুমি কি অচলায়তনের বাইরে গিয়ে শোণপাংশু-জাতির সঙ্গে মেশ?
পঞ্চক। আপনি কি এর উত্তর শুনতে চান?
আচার্য। না না, থাক্, বোলো না। কিন্তু শোণপাংশুরা যে অত্যন্ত ম্লেচ্ছ। তাদের সহবাস কি-
পঞ্চক। তাদের সম্বন্ধে আপনার কি কোনো বিশেষ আদেশ আছে।
আচার্য। না না, আদেশ আমার কিছুই নেই। যদি ভুল করতে হয় তবে ভুল করো গে—তুমি ভুল করো গে—আমাদের কথা শুনো না। আমাদের গুরু আসছেন পঞ্চক—তাঁর কাছে তোমার মতো বালক হয়ে যদি বসতে পারি—তিনি যদি আমার জরার বন্ধন
খুলে দেন, আমাকে ছেড়ে দেন, তিনি যদি অভয় দিয়ে বলেন আজ থেকে ভুল করে করে সত্য জানবার অধিকার তোমাকে দিলুম, আমার মনের উপর থেকে হাজার দু-হাজার বছরের পুরাতন ভার যদি তিনি নামিয়ে দেন!
পঞ্চক। ঐ উপাচার্য আসছেন —বোধ করি কাজের কথা আছে—বিদায় হই।
[ প্রস্থান
উপাধ্যায় ও উপাচার্যের প্রবেশ
উপাচার্য। (উপাধ্যায়ের প্রতি) আচার্যদেবকে তো বলতেই হবে। উনি নিতান্ত উদ্বিগ্ন হবেন—কিন্তু দায়িত্ব যে ওঁরই।
আচার্য। উপাধ্যায়, কোনো সংবাদ আছে নাকি?
উপাধ্যায়। অত্যন্ত মন্দ সংবাদ।
আচার্য। অতএব সেটা সত্বর বলা উচিত।
উপাচার্য। উপাধ্যায়, কথাটা বলে ফেলো। এদিকে প্রতিকারের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রহাচার্য বলছেন আজ তিন প্রহর সাড়ে তিন দণ্ডের মধ্যে দ্ব্যাত্মকচরাংশলগ্নে যা-কিছু করবার সময়—সেটা অতিক্রম করলেই গোপরিক্রমণ আরম্ভ হবে, তখন প্রায়শ্চিত্তের কেবল এক পাদ হবে বিপ্র, অর্ধ পাদ বৈশ্য, বাকি সমস্তটাই শূদ্র।
উপাধ্যায়। আচার্যদেব, সুভদ্র আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে।
আচার্য। উত্তর দিকটা তো একজটা দেবীর।
উপাধ্যায়। সেই তো ভাবনা। আমাদের আয়তনের মন্ত্রঃপূত রুদ্ধ বাতাসকে সেখানকার হাওয়া কতটা দূর পর্যন্ত আক্রমণ করেছে বলা তো যায় না।
উপাচার্য। এখন কথা হচ্ছে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী।
আচার্য। আমার তো স্মরন হয় না। উপাধ্যায় বোধ করি-
উপাধ্যায়। না, আমিও তো মনে আনতে পারি নে। আজ তিনশো বছর এ প্রায়শ্চিত্তটার প্রয়োজন হয় নি— সবাই ভুলেই গেছে। ঐ-যে মহাপঞ্চক আসছে—যদি কারও জানা থাকে তো সে ওর।
মহাপঞ্চকের প্রবেশ
উপাধ্যায়। মহাপঞ্চক, সব শুনেছ বোধ করি।
মহাপঞ্চক। সেইজন্যেই তো এলুম; আমরা এখন সকলেই অশুচি, বাহিরের হাওয়া আমাদের আয়তনে প্রবেশ করেছে।
উপাচার্য। এর প্রায়শ্চিত্ত কী, আমাদের কারো স্মরণ নেই—তুমিই বলতে পার।
মহাপঞ্চক। ক্রিয়াকল্পতরুতে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না—একমাত্র ভগবান জ্বলনানন্তকৃত আধিকর্মিক বর্ষায়ণে লিখছে অপরাধীকে ছয় মাস মহাতামস সাধন করতে হবে।
উপাচার্য। মহাতামস?
মহাপঞ্চক। হাঁ, আলোকের এক রশ্মিমাত্র সে দেখতে পাবে না। কেননা আলোকের দ্বারা যে অপরাধ অন্ধকারের দ্বারাই তার ক্ষালন।
উপাচার্য। তা হলে, মহাপঞ্চক, সমস্ত ভার তোমার উপর রইল।
উপাধ্যায়। চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। ততক্ষণ সুভদ্রকে হিঙ্গুমর্দনকুণ্ডে স্নান করিয়ে আনি গে।
সকলের গমনোদ্যম
আচার্য। শোনো, প্রয়োজন নেই।
উপাধ্যায়। কিসের প্রয়োজন নেই?
আচার্য। প্রায়শ্চিত্তের।
মহাপঞ্চক। প্রয়োজন নেই বলছেন! আধিকর্মিক বর্ষায়ণ খুলে আমি এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি—
আচার্য। দরকার নেই —সুভদ্রকে কোনো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না, আমি আশীর্বাদ করে তার—
মহাপঞ্চক। এও কি কখনো সম্ভব হয়? যা কোনো শাস্ত্রে নেই আপনি কি তাই—
আচার্য। না, হতে দেব না, যদি কোনো অপরাধ ঘটে সে আমার। তোমাদের ভয় নেই।
উপাধ্যায়। এরকম দুর্বলতা তো আপনার কোনোদিন দেখি নি। এই তো সেবার অষ্টাঙ্গশুদ্ধি উপবাসে তৃতীয় রাত্রে বালক কুশলশীল ‘জল জল’করে পিপাসায় প্রাণত্যাগ করলে কিন্তু তবু তার মুখে যখন এক বিন্দু জল দেওয়া গেল না তখন তো আপনি নীরব হয়ে ছিলেন। তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তো চিরকালের।
সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের প্রবেশ
পঞ্চক। ভয় নেই সুভদ্র, তোর কোনো ভয় নেই।—এই শিশুটিকে অভয় দাও প্রভু।
আচার্য। বৎস, তুমি কোনো পাপ কর নি বৎস, যারা বিনা অপরাধে তোমাকে হাজার হাজার বৎসর ধরে মুখ বিকৃত করে ভয় দেখাচ্ছে পাপ তাদেরই। এসো পঞ্চক।
[ সুভদ্রকে কোলে লইয়া পঞ্চকের সঙ্গে প্রস্থান
উপাধ্যায়। এ কী হল উপাচার্যমশায়!
মহাপঞ্চক। আমরা অশুচি হয়ে রইলুম, আমাদের যাগযজ্ঞ ব্রত-উপবাস সমস্তই পণ্ড হতে থাকল, এ তো সহ্য করা শক্ত।
উপাধ্যায়। এ সহ্য করা চলবেই না। আচার্য কি শেষে আমাদের ম্লেচ্ছের সঙ্গে সমান করে দিতে চান!
মহাপঞ্চক। উনি আজ সুভদ্রকে বাঁচাতে গিয়ে সনাতনধর্মকে বিনাশ করবেন! এ কী রকম বুদ্ধিবিকার ওঁর ঘটল! এ অবস্থায় ওঁকে আচার্য বলে গণ্য করাই চলবে না।
উপাচার্য। সে কি হয়! যিনি একবার আচার্য হয়েছেন তাঁকে কি আমাদের ইচ্ছামতো—
মহাপঞ্চক। উপাচার্যমশায়, আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে।
উপাচার্য। নূতন কিছুতে যোগ দেবার বয়স আমার নয়।
উপাধ্যায়। আজ বিপদের সময় বয়স-বিচার!
উপাচার্য। ধর্মকে বাঁচাবার জন্যে যা করবার করো। আমাকে দাঁড়াতে হবে আচার্যদেবের পাশে। আমরা একসঙ্গে এসেছিলুম, যদি বিদায় হবার দিন এসে থাকে তবে একসঙ্গেই বাহির হয়ে যাব।
মহাপঞ্চক। কিন্তু একটা কথা চিন্তা করে দেখবেন। আচার্যদেবের অভাবে আপনারই আচার্য হবার অধিকার।
উপাচার্য। মহাপঞ্চক, সেই প্রলোভনে আমি আচার্যদেবের বিরুদ্ধে দাঁড়াব? এ কথা বলবার জন্যে তুমি যে মুখ খুলেছ সে কি এখানকার উত্তর দিকের জানলা খোলার চেয়ে কম পাপ!
[ প্রস্থান
মহাপঞ্চক। চলো উপাধ্যায়, আর বিলম্ব নয়। আচার্য অদীনপুণ্য যতক্ষণ এ আয়তনে থাকবেন ততক্ষণ ক্রিয়াকর্ম সমস্ত বন্ধ, ততক্ষণ আমাদের অশৌচ। 
পাহাড়-মাঠ
পঞ্চকের গান
এ পথ গেছে কোন্খানে গো কোন্খানে—
    তা  কে জানে তা কে জানে।
কোন্ পাহাড়ের পারে,   কোন্ সাগরের ধারে,
    কোন্ দুরাশার দিক-পানে—
    তা  কে জানে তা কে জানে।
এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্খানে
    তা  কে জানে তা কে জানে।
কেমন যে তার বাণী,   কেমন হাসিখানি,
    যায় সে কাহার সন্ধানে
    তা  কে জানে তা কে জানে।
পশ্চাতে আসিয়া শোণপাংশুদলের নৃত্য
পঞ্চক। ও কী রে! তোরা কখন পিছনে এসে নাচতে লেগেছিস?
প্রথম শোণপাংশু। আমরা নাচবার সুযোগ পেলেই নাচি, পা-দুটোকে স্থির রাখতে পারি নে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আয় ভাই, ওকে সুদ্ধ কাঁধে করে নিয়ে একবার নাচি।
পঞ্চক। আরে না না, আমাকে ছুঁস নে রে, ছুঁস নে।
তৃতীয় শোণপাংশু। ঐ রে! ওকে অচলায়তনের ভূতে পেয়েছে। শোণপাংশুকে ও ছোঁবে না।
পঞ্চক। জানিস, আমাদের গুরু আসবেন?
প্রথম শোণপাংশু। সত্যি নাকি! তিনি মানুষটি কী রকম? তাঁর মধ্যে নতুন কিছু আছে?
পঞ্চক। নতুনও আছে, পুরোনোও আছে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আচ্ছা, এলে খবর দিয়ো—একবার দেখব তাঁকে।
পঞ্চক। তোরা দেখবি কী রে। সর্বনাশ। তিনি তো শোণপাংশুদের গুরু নন। তাঁর কথা তোদের কানে পাছে এক অক্ষরও যায় সেজন্যে তোদের দিকের প্রাচীরের বাইরে সাত সার রাজার সৈন্য পাহারা দেবে। তোদেরও তো গুরু আছে— তাকে নিয়েই—
তৃতীয় শোণপাংশু। গুরু! আমাদের আবার গুরু কোথায়! আমরা তো হলুম দাদাঠাকুরের দল। এ-পর্যন্ত আমরা তো কোনো গুরুকে মানি নি।
প্রথম শোণপাংশু। সেইজন্যেই তো ও-জিনিসটা কী রকম দেখতে ইচ্ছা করে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আমাদের মধ্যে একজন, তার নাম চণ্ডক—তার কী জানি ভারি লোভ হয়েছে; সে ভেবেছে তোমাদের কোনো গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়ে আশ্চর্য কী-একটা ফল পাবে—তাই সে লুকিয়ে চলে গেছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। কিন্তু শোণপাংশু বলে কেউ তাকে মন্ত্র দিতে চায় না; সেও ছাড়বার ছেলে নয়, সে লেগেই রয়েছে। তোমরা মন্ত্র দাও না বলেই মন্ত্র আদায় করবার জন্যে তার এত জেদ।
প্রথম শোণপাংশু। কিন্তু পঞ্চকদাদা, আমাদের ছুঁলে কি তোমার গুরু রাগ করবেন?
পঞ্চক। বলতে পারি নে—কী জানি যদি অপরাধ নেন। ওরে তোরা যে সবাই সবরকম কাজই করিস— সেইটে যে বড়ো দোষ। তোরা চাষ করিস তো?
প্রথম শোণপাংশু। চাষ করি বৈকি, খুব করি। পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব ক’ষে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।
গান
আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে।
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে      বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে।
সবুজ প্রাণের গানের লেখা     রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে      সকল ধরা হেসে ওঠে,
অঘ্রানেরি সোনার রোদে পূর্ণিমারই চন্দ্রে।
পঞ্চক। আচ্ছা, নাহয় তোরা চাষই করিস সেও কোনোমতে সহ্য হয়—কিন্তু কে বলছিল তোরা কাঁকুড়ের চাষ করিস।
প্রথম শোণপাংশু। করি বৈকি।
পঞ্চক। কাঁকুড় ! ছি ছি! খেঁসারিডালেরও চাষ করিস বুঝি?
তৃতীয় শোণপাংশু। কেন করব না? এখান থেকেই তো কাঁকুড় খেঁসারিডাল তোমাদের বাজারে যায়।
পঞ্চক। তা তো যায়, কিন্তু জানিস নে কাঁকুড় আর খেঁসারিডাল যারা চাষ করে তাদের আমরা ঘরে ঢুকতে দিই নে।
প্রথম শোণপাংশু। কেন?
পঞ্চক। কেন কী রে! ওটা যে নিষেধ।
প্রথম শোণপাংশু। কেন নিষেধ?
পঞ্চক। শোনো একবার! নিষেধ, তার আবার কেন! সাধে তোদের মুখদর্শন পাপ! এই সহজ কথাটা বুঝিস নে যে কাঁকুড় আর খেঁসারিডালের চাষটা ভয়ানক খারাপ।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কেন? ওটা কি তোমরা খাও না?
পঞ্চক। খাই বৈকি, খুব আদর করে খাই—কিন্তু ওটা যারা চাষ করে তাদের ছায়া মাড়াই নে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কেন?
পঞ্চক। ফের কেন! তোরা যে এতবড়ো নিরেট মূর্খ তা জানতুম না। আমাদের পিতামহ বিষ্কম্ভী কাঁকুরের মধ্যে জন্মগ্রহণ
করেছিলেন, সে খবর রাখিস নে বুঝি?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কাঁকুড়ের মধ্যে কেন?
পঞ্চক। আবার কেন! তোরা যে ঐ এক কেন’র জ্বালায় আমাকে অতিষ্ঠ করে তুললি।
তৃতীয় শোণপাংশু। আর, খেঁসারির ডাল?
পঞ্চক। একবার কোন্ যুগে একটা খেঁসারিডালের গুঁড়ো উপবাসের দিন কোন্ এক মস্ত বুড়োর ঠিক গোঁফের উপর উড়ে পড়েছিল; তাতে তাঁর উপবাসের পুণ্যফল থেকে ষষ্টিসহস্র ভাগের এক ভাগ কম পড়ে গিয়েছিল; তাই তখনই সেইখানে দাঁড়িয়ে উঠে তিনি জগতের সমস্ত খেঁসারিডালের খেতের উপর অভিশাপ দিয়ে গেছেন। এত-বড়ো তেজ। তোরা হলে কী করতিস বল্ দেখি।
প্রথম শোণপাংশু। আমাদের কথা বল কেন? উপবাসের দিনে খেঁসারিডাল যদি গোঁফের উপর পর্যন্ত এগিয়ে আসে তা হলে তাকে আরও একটু এগিয়ে নিই।
পঞ্চক। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্যি করে বলিস্—তোরা কি লোহার কাজ করে থাকিস?
প্রথম শোণপাংশু। লোহার কাজ করি বৈকি, খুব করি।
পঞ্চক। রাম! রাম! আমরা সনাতন কাল থেকে কেবল তামা-পিতলের কাজ করে আসছি। লোহা গলাতে পারি কিন্তু সব দিন নয়। ষষ্ঠীর দিনে যদি মঙ্গলবার পড়ে তবেই স্নান করে আমরা হাপর ছুঁতে পারি, কিন্তু তাই বলে লোহা পিটোনো—সে তো হতেই পারে না!
তৃতীয় শোণপাংশু। আমরা লোহার কাজ করি, তাই লোহাও আমাদের কাজ করে। 

গান
কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন ,
ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে!
লক্ষযুগের অন্ধকারে ছিল সংগোপন,
ওগো, তায় জাগাইনু রে।
পোষ মেনেছে হাতের তলে,
যা বলাই সে তেমনি বলে,
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে।
অচল ছিল, সচল হয়ে
ছুটেছে ঐ জগৎ জয়ে,
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে।
পঞ্চক। সেদিন উপাধ্যায়মশায় একঘর ছাত্রের সামনে বললেন শোণপাংশু জাতটা এমনই বিশ্রী যে, তারা নিজের হাতে লোহার কাজ করে। আমি তাঁকে বললুম, ও বেচারারা পড়াশুনো কিছুই করে নি সে আমি জানি— এমন-কি, এই পৃথিবীটা যে ত্রিশিরা রাক্ষসীর মাথামুড়োনো চুলের জটা দিয়ে তৈরি তাও ঐ মূর্খেরা জানে না, আবার সে কথা বলতে গেলে মারতে আসে— তাই বলে ভালোমন্দর জ্ঞান কি ওদের এতটুকুও নেই যে, লোহার কাজ নিজের হাতে করবে। আজ তো স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, যার যে বংশে জন্ম তার সেইরকম বুদ্ধিই হয়।
প্রথম শোণপাংশু। কেন, লোহা কী অপরাধটা করেছে।
পঞ্চক। আরে, ওটা যে লোহা সে তো তোকে মানতেই হবে।
প্রথম শোণপাংশু। তা তো হবে।
পঞ্চক। তবে আর কি—এই বুঝে নে না।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। তবু একটা তো কারণ আছে।
পঞ্চক। কারণ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কেবল সেটা পুথির মধ্যে। সুতরাং মহাপঞ্চকদাদা ছাড়া আর অতি অল্প লোকেরই জানবার সম্ভাবনা আছে। সাধে মহাপঞ্চকদাদাকে ওখানকার ছাত্রেরা একেবারে পূজা করে! যা হোক ভাই, তোরা যে আমাকে ক্রমেই আশ্চর্য করে দিলি রে। তোরা তো খেঁসারিডাল চাষ করছিস আবার লোহাও পিটোচ্ছিস, এখনো তোরা কোনো দিক থেকে কোনো পাঁচ-চোখ কিংবা সাত-মাথাওয়ালার কোপে পড়িস নি?
প্রথম শোণপাংশু। যদি পড়ি তবে আমাদেরও লোহা আছে, তারও কোপ বড়ো কম নয়।
পঞ্চক। আচ্ছা, তোদের মন্ত্র কেউ পড়ায় নি?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। মন্ত্র! কিসের মন্ত্র।
পঞ্চক। এই মনে কর্ যেমন বজ্রবিদারণ মন্ত্র—তট তট তোতয় তোতয়—
তৃতীয় শোণপাংশু। ওর মানে কী!
পঞ্চক। আবার! মানে! তোর আস্পর্ধা তো কম নয়। সব কথাতেই মানে! কেয়ূরী মন্ত্রটা জানিস?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। মরীচি?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। মহাশীতবতী?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। উষ্ণীষবিজয়?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। নাপিত ক্ষৌর করতে করতে যেদিন তোদের বাঁ গালে রক্ত পাড়িয়ে দেয় সেদিন করিস কী।
তৃতীয় শোণপাংশু। সে দিন নাপিতের দুই গালে চড় কষিয়ে দিই।
পঞ্চক। না রে না, আমি বলছি সে দিন নদী পার হবার দরকার হলে তোরা খেয়া-নৌকোয় উঠতে পারিস?
তৃতীয় শোণপাংশু। খুব পারি।
পঞ্চক। ওরে, তোরা আমাকে মাটি করলি রে। আমি আর থাকতে পারছি নে। তোদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে আর সাহস হচ্ছে না। এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তোদের বুকে করে পাগলের মতো নাচব, আমার জাত-মান কিছু থাকবে না। ভাই, তোরা সব কাজই করতে পাস? তোদের দাদাঠাকুর কিছুতেই তোদের মানা করে না?
শোণপাংশুগণের গান
সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজেই।
বাধাবাঁধন নেই গো নেই।
        দেখি, খুঁজি, বুঝি,
কেবল  ভাঙি, গড়ি, যুঝি,
মোরা  সব দেশেতেই বেড়াই ঘুরে সব সাজেই।
        পারি, নাইবা পারি,
নাহয়  জিতি কিংবা হারি,
যদি  অমনিতে হাল ছাড়ি, মরি সেই লাজেই।
        আপন হাতের জোরে
আমরা  তুলি সৃজন করে,
আমরা  প্রাণ দিয়ে ঘর বাঁধি, থাকি তার মাঝেই।
পঞ্চক। সর্বনাশ করলে রে—আমার সর্বনাশ করলে। আমার আর ভদ্রতা রাখলে না। এদের তালে তালে আমারও পা-দুটো নেচে উঠছে। আমাকে সুদ্ধ এরা টানবে দেখছি। কোন্ দিন আমিও লোহা পিটব রে, লোহা পিটব—কিন্তু খেঁসারির ডাল—না না, পালা ভাই, পালা তোরা। দেখছিস নে, পড়ব বলে পুঁথি সংগ্রহ করে এনেছি।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। ও কী পুঁথি দাদা? ওতে কী আছে?
পঞ্চক। এ আমাদের দিক্চক্রচন্দ্রিকা—এতে বিস্তর কাজের কথা আছে রে।
প্রথম শোণপাংশু। কিরকম?
পঞ্চক। দশটা দিকের দশ রকম রঙ গন্ধ আর স্বাদ আছে কি না এতে তার সমস্ত খোলসা করে লিখেছে। দক্ষিণ দিকের রঙটা হচ্ছে রুইমাছের পেটের মতো, ওর গন্ধটা দধির গন্ধ, স্বাদটা ঈষৎ মিষ্টি; পুব দিকের রঙটা হচ্ছে সবুজ, গন্ধটা মদমত্ত হাতির মতো, স্বাদটা বকুলের ফলের মতো কষা—নৈর্ঋত কোণের—
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আর বলতে হবে না দাদা। কিন্তু দশ দিকে তো আমরা এ-সব রঙ গন্ধ দেখতে পাইনে।
পঞ্চক। দেখতে পেলে তো দেখাই যেত। যে ঘোর মূর্খ সেও দেখত। এ-সব কেবল পুঁথিতে পড়তে পাওয়া যায়, জগতে কোথাও দেখবার জো নেই।
প্রথম শোণপাংশু। তা হলে দাদা তুমি পুঁথিই পড়ো, আমরা চললুম।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। এদের মতো চোখকান বুজে যদি আমাদের বসে বসে ভাবতে হত তা হলে তো আমরা পাগল হয়ে যেতুম।
তৃতীয় শোণপাংশু। চল্ ভাই, ঘুরে আসি, শিকারের সন্ধান পেয়েছি। নদীর ধারে গণ্ডারের পায়ের চিহ্ন দেখা গেছে। [ প্রস্থান
পঞ্চক। এই শোণপাংশুগুলো বাইরে থাকে বটে, কিন্তু দিনরাত্রি এমনি পাক খেয়ে বেড়ায় যে, বাহিরটাকে দেখতেই পায় না। এরা যেখানে থাকে সেখানে একেবারে অস্থিরতার চোটে চতুর্দিক ঘুলিয়ে যায়। এরা একটু থেমেছে অমনি সমস্ত আকাশটা যেন গান গেয়ে উঠেছে। এই শোণপাংশুদের দেখছি ওরা চুপ করলেই আর কিছু শুনতে পায় না—ওরা নিজের গোলমালটা শোনে সেইজন্যে এত গোল করতে ভালোবাসে। কিন্তু এই আলোতে ভরা নীল আকাশটা আমার রক্তের ভিতরে গিয়ে কথা কচ্ছে, আমার সমস্ত শরীরটা গুন গুন করে বেড়াচ্ছে।
গান
ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।
আলোতে কোন্ গগনে
মাধবী জাগল বনে,
এলো সেই ফুল জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে রহি ঘরে,
মন যে কেমন করে,
কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।
কী মায়া দেয় বুলায়ে;
দিল সব কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।
শোণপাংশুদলের পুনঃপ্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। ও ভাই পঞ্চক, দাদাঠাকুর আসছে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। এখন রাখো তোমার পুঁথি রাখো—দাদাঠাকুর আসছে।
দাদাঠাকুরের প্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। দাদাঠাকুর!
দাদাঠাকুর। কী রে?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। দাদাঠাকুর।
দাদাঠাকুর। কী চাই রে?
তৃতীয় শোণপাংশু। কিছু চাই নে—একবার তোমাকে ডেকে নিচ্ছি।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর!
দাদাঠাকুর। কী ভাই, পঞ্চক যে।
পঞ্চক। ওরা সবাই তোমায় ডাকছে, আমারও কেমন ডাকতে ইচ্ছে হল। যতই ভাবছি ওদের দলে মিশব না ততই আরো জড়িয়ে পড়ছি।
প্রথম শোণপাংশু। আমাদের দাদাঠাকুরকে নিয়ে আবার দল কিসের। উনি আমাদের সব দলের শতদল পদ্ম।
গান
এই    একলা মোদের হাজার মানুষ
        দাদাঠাকুর।
এই    আমাদের মজার মানুষ
        দাদাঠাকুর।
        এই তো নানা কাজে,
এই তো নানা সাজে,
এই    আমাদের খলার মানুষ
        দাদাঠাকুর।
সব মিলনে মেলার মানুষ
        দাদাঠাকুর।
        এই তো হাসির দলে,
        এই তো চোখের জলে,
এই তো সকল ক্ষণের মানুষ
        দাদাঠাকুর।
        এই তো ঘরে ঘরে,
        এই তো বাহির করে,
এই আমাদের কোণের মানুষ
         দাদাঠাকুর।
এই আমাদের মনের মানুষ
         দাদাঠাকুর।
পঞ্চক। ও ভাই, তোদের দাদাঠাকুরকে নিয়ে তোরা তো দিনরাত মাতামাতি করছিস, একবার আমাকে ছেড়ে দে, আমি একটু নিরালায় বসে কথা কই। ভয় নেই, ওঁকে আমাদের অচলায়তনে নিয়ে গিয়ে কপাট দিয়ে রাখব না।
প্রথম শোণপাংশু। নিয়ে যাও না। সে তো ভালোই হয়। তা হলে কপাটের বাপের সাধ্য নেই বন্ধ থাকে। উনি গেলে তোমাদের অচলায়তনের পাথরগুলো-সুদ্ধ নাচতে আরম্ভ করবে, পুঁথিগুলোর মধ্যে বাঁশি বাজবে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আচ্ছা, আয় ভাই, আমাদের কাজগুলো সেরে আসি। দাদাঠাকুরকে নিয়ে পঞ্চকদাদা একটু বসুক।
[ প্রস্থান
পঞ্চক। ঐ শোণপাংশুগুলো গেছে, এইবার তোমার পায়ের ধুলো নিই দাদাঠাকুর। ওরা দেখলে হেসে অস্থির হত তাই ওদের সামনে কিছু করি নে।
দাদাঠাকুর। দরকার কী ভাই পায়ের ধুলোয়।
পঞ্চক। নিতে ইচ্ছে করে। বুকের ভিতরটা যখন ভরে ওঠে, তখন বুঝি তার ভারে মাথা নিচু হয়ে পড়ে— ভক্তি না করে যে বাঁচি নে।
দাদাঠাকুর। ভাই, আমিও থাকতে পারি নে। স্নেহ যখন আমার হৃদয়ে ধরে না, তখন সেই স্নেহই আমার ভক্তি।
পঞ্চক। অচলায়তনে প্রণাম করে করে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে। তাতে নিজেকেই কেবল ছোটো করেছি, বড়োকে পাই নি।
দাদাঠাকুর। এই আমার সবার বাড়া বড়োর মধ্যে এসে যখন বসি তখন যা করি তাই প্রণাম হয়ে ওঠে। এই-যে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মন তোমাকে আশীর্বাদ করছে—এও আমার প্রণাম।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, তোমার দুই চোখ দিয়ে এই-যে তুমি কেবল সেই বড়োকে দেখছ, তোমাকে যখন দেখি তখন তোমার সেই দেখাটিকেও আমি যেন পাই। তখন পশুপাখি গাছপালা আমার কাছে আর কিছুই ছোটো থাকে না। এমন-কি, তখন ঐ শোণপাংশুদের সঙ্গে মাতামাতি করতেও আমার আর বাধে না।
দাদাঠাকুর। আমিও যে ওদের সঙ্গে খেলে বেড়াই সে খেলা আমার কাছে মস্ত খেলা। আমার মনে হয় আমি ঝরনার ধারার সঙ্গে খেলছি, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে খেলছি।
পঞ্চক। তোমার কাছে সবই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
দাদাঠাকুর। না ভাই, বড়ো হয় নি, সত্য হয়ে উঠেছে —সত্য যে বড়োই, ছোটোই তো মিথ্যা।
পঞ্চক। তোমার বাধা কেটে গেছে দাদাঠাকুর, সব বাধা কেটে গেছে। এমন হাসতে খেলতে, মিলতে মিশতে, কাজ করতে, কাজ ছাড়তে কে পারে! তোমার ঐ ভাব দেখে আমার মনটা ছট্ফট্ করতে থাকে। ঐ যে কী একটা আছে—চরম, না পরম, না কী, তা কে বলবে—তার জন্যে দিনরাত যেন আমার মন কেমন করে। থেকে থেকে এক-একবার চমকে উঠি, আর ভাবি এইবার বুঝি হল, বুঝি পাওয়া গেল। দাদাঠাকুর, শুনছি আমাদের গুরু আসবেন।
দাদাঠাকুর। গুরু! কী বিপদ। ভারি উৎপাত করবে তা হলে তো।
পঞ্চক। একটু উৎপাত হলে যে বাঁচি। চুপচাপ থেকে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে।
দাদাঠাকুর। তোমার যে শিক্ষা কাঁচা রয়েছে, মনে ভয় হচ্ছে না?
পঞ্চক। আমার ভয় সব-চেয়ে কম—আমার একটি ভুলও হবে না।
দাদাঠাকুর। হবে না?
পঞ্চক। একেবারে কিছুই জানি নে, ভুল করবার জায়গাই নেই। নির্ভয়ে চুপ করে থাকব।
দাদাঠাকুর। আচ্ছা বেশ, তোমার গুরু এলে তাঁকে দেখে নেওয়া যাবে। এখন তুমি আছ কেমন বলো তো।
পঞ্চক। ভয়ানক টানাটানির মধ্যে আছি ঠাকুর। মনে মনে প্রার্থনা করছি গুরু এসে যেদিকে হোক একদিকে আমাকে ঠিক করে রাখুন—হয় এখানকার খোলা হাওয়ার মধ্যে অভয় দিয়ে ছাড়া দিন, নয় তো খুব কষে পুঁথি চাপা দিয়ে রাখুন; মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া একেবারে সমান চ্যাপটা হয়ে যাই।
দাদাঠাকুর। তা, তোমার গুরু তোমার উপর যত পুঁথির চাপই চাপান না কেন, তার নীচের থেকে তোমাকে আস্ত টেনে বের করে আনতে পারব।
পঞ্চক। তা তুমি পারবে সে আমি জানি। কিন্তু দেখো ঠাকুর, একটা কথা তোমাকে বলি—অচলায়তনের মধ্যে ঐ- যে আমরা দরজা বন্ধ করে আছি, দিব্যি আছি। ওখানে আমাদের সমস্ত বোঝাপড়া একেবারে শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার মানুষ সেইজন্যে বড়ো নিশ্চিন্ত। কিছুতে কারও একটু সন্দেহ হবার জো নেই। যদি দৈবাৎ কারও মনে এমন প্রশ্ন ওঠে যে, আচ্ছা ওই যে চন্দ্রগ্রহণের দিনে শোবার ঘরের দেওয়ালে তিনবার সাদা ছাগলের দাড়ি বুলিয়ে দিয়ে আওড়াতে হয় “হুন হুন তিষ্ঠ তিষ্ঠ বন্ধ বন্ধ অমৃতের হূঁ ফট স্বাহা” এর কারণটা কী— তা হলে কেবলমাত্র চারটে সুপুরি আর এক মাষা সোনা হাতে করে যাও তখনই মহাপঞ্চকদাদার কাছে, এমনি উত্তরটি পাবে যে আর কথা সরবে না। হয় সেটা মানো, নয় কানমলা খেয়ে বেরিয়ে যাও, মাঝে অন্য রাস্তা নেই। তাই সমস্তই চমৎকার সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ঠাকুর, সেখান থেকে বের করে তুমি আমাকে এই যে জায়গাটাতে এনেছ এখানে কোনো মহাপঞ্চকদাদার টিকি দেখবার জো নেই—বাঁধা জবাব পাই কার কাছে। সব কথারই বারো আনা বাকি থেকে যায়। তুমি এমন করে মনটাকে উতলা করে দিলে—তার পর?
দাদাঠাকুর। তার পর?
গান
যা হবার তা হবে।
যে আমাকে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে।
পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে,      পথ যে কোথায় সেই তা জানে,
ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায় সেই তো ঘরে লবে।
পঞ্চক। এতবড়ো ভরসা তুমি কেমন করে দিচ্ছ ঠাকুর! তুমি কোনো ভয় কোনো ভাবনাই রাখতে দেবে না, অথচ জন্মাবধি আমাদের ভয়ের অন্ত নেই। মৃত্যু-ভয়ের জন্যে অমিতায়ুর্ধারিণী মন্ত্র পড়ছি, শত্রুভয়ের জন্যে মহাসাহস্রপ্রমর্দিনী, ঘরের ভয়ের জন্যে গৃহমাতৃকা, বাইরের ভয়ের জন্যে অভয়ংকরী, সাপের ভয়ের জন্যে মহাময়ূরী, বজ্রভয়ের জন্যে বজ্রগান্ধারী, ভূতের ভয়ের জন্যে চণ্ডভট্টারিকা, চোরের ভয়ের জন্যে হরাহরহৃদয়া। এমন আর কত নাম করব।
দাদাঠাকুর। আমার বন্ধু এমন মন্ত্র আমাকে পড়িয়েছেন যে তাতে চিরদিনের জন্য ভয়ের বিষদাঁত ভেঙে যায়।
পঞ্চক। তোমাকে দেখে তা বোঝা যায়। কিন্তু সেই বন্ধুকে পেলে কোথা ঠাকুর।
দাদাঠাকুর। পাবই বলে সাহস করে বুক বাড়িয়ে দিলুম, তাই পেলুম। কোথাও যেতে হয় নি।
পঞ্চক। সে কী রকম।
দাদাঠাকুর। যে ছেলের ভরসা নেই সে অন্ধকারে বিছানায় মাকে না দেখতে পেলেই কাঁদে, আর যার ভরসা আছে সে হাত বাড়ালেই মাকে তখনই বুক ভরে পায়। তখন ভয়ের অন্ধকারটাই আরো নিবিড় মিষ্টি হয়ে ওঠে। মা তখন যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘আলো চাই’? ছেলে বলে, ‘তুমি থাকলে আমার আলোও যেমন অন্ধকারও তেমনি’।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, আমার অচলায়তন ছেড়ে অনেক সাহস করে তোমার কাছ অবধি এসেছি, কিন্তু তোমার ওই বন্ধু পর্যন্ত যেতে সাহস করতে পারছি নে।
দাদাঠাকুর। কেন তোমার ভয় কিসের?
পঞ্চক। খাঁচায় যে পাখিটার জন্ম, সে আকাশকেই সব চেয়ে ডরায়। সে লোহার শলাগুলোর মধ্যে দুঃখ পায় তবু দরজাটা খুলে দিলে তার বুক দুর্ দুর্ করে, ভাবে, ‘বন্ধ না থাকলে বাঁচব কী করে’। আপনাকে যে নির্ভয়ে ছেড়ে দিতে শিখি নি। এইটেই আমাদের চিরকালের অভ্যাস।
দাদাঠাকুর। তোমরা অনেকগুলো তালা লাগিয়ে সিন্দুক বন্ধ করে রাখাকেই মস্ত লাভ মনে কর—কিন্তু সিন্দুকে যে আছে কী তার খোঁজ রাখ না।
পঞ্চক। আমার দাদা বলে, জগতে যা-কিছু আছে সমস্তকে দূর করে ফেলতে পারলে তবেই আসল জিনিসকে পাওয়া যায়। সেইজন্যেই দিনরাত্রি আমরা কেবল দূরই করছি—আমাদের কতটা গেল সেই হিসাবটাই আমাদের হিসাব—সে হিসাবের অন্তও পাওয়া যাচ্ছে না।
দাদাঠাকুর। তোমার দাদা তো ঐ বলে, কিন্তু আমার দাদা বলে, যখন সমস্ত পাই তখনই আসল জিনিসকে পাই। সেইজন্যে ঘরে আমি দরজা দিতে পারি নে—দিনরাত্রি সব খুলে রেখে দিই। আচ্ছা পঞ্চক, তুমি যে তোমাদের আয়তন থেকে বেরিয়ে আস কেউ তা জানে না?
পঞ্চক। আমি জানি যে আমাদের আচার্য জানেন। কোনোদিন তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা হয় নি—তিনিও জিজ্ঞাসা
করেন না, আমিও বলি নে। কিন্তু আমি যখন বাইরে থেকে ফিরে যাই তিনি আমাকে দেখলেই বুঝতে পারেন। আমাকে তখন কাছে নিয়ে বসেন, তাঁর চোখের যেন একটা কী ক্ষুধা তিনি আমাকে দেখে মেটান। যেন বাইরের আকাশটাকে তিনি আমার মুখের মধ্যে দেখে নেন। ঠাকুর, যেদিন তোমার সঙ্গে আচার্যদেবকে মিলিয়ে দিতে পারব সেদিন আমার অচলায়তনের সব দুঃখ ঘুচবে।
দাদাঠাকুর। সেদিন আমারও শুভদিন হবে।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমাকে কিন্তু তুমি বড়ো অস্থির করে তুলেছ। এক-একসময় ভয় হয় বুঝি কোনোদিন আর মন শান্ত হবে না।
দাদাঠাকুর। আমিই কি স্থির আছি ভাই? আমার মধ্যে ঢেউ উঠেছে বলেই তোমারও মধ্যে ঢেউ তুলছি।
পঞ্চক। কিন্তু তবে যে তোমার ঐ শোণপাংশুরা বলে তোমার কাছে তারা খুব শান্তি পায়, কই, শান্তি কোথায়! আমি তো দেখি নে।
দাদাঠাকুর। ওদের যে শান্তি চাই। নইলে কেবলই কাজের ঘর্ষণে ওদের কাজের মধ্যেই দাবানল লেগে যেত, ওদের পাশে কেউ দাঁড়াতে পারত না।
পঞ্চক। তোমাকে দেখে ওরা শান্তি পায়?
দাদাঠাকুর। এই পাগল যে পাগলও হয়েছে শান্তিও পেয়েছে। তাই সে কাউকে খ্যাপায়, কাউকে বাঁধে। পূর্ণিমার চাঁদ সাগরকে উতলা করে যে মন্ত্রে, সেই মন্ত্রেই পৃথিবীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
পঞ্চক। ঢেউ তোলো ঠাকুর, ঢেউ তোলো। কূল ছাপিয়ে যেতে চাই। আমি তোমায় সত্যি বলছি আমার মন খেপেছে, কেবল জোর পাচ্ছি নে—তাই দাদাঠাকুর, মন কেবল তোমার কাছে আসতে চায়—তুমি জোর দাও—তুমি জোর দাও—তুমি আর দাঁড়াতে দিয়ো না।
গান
        আমি কারে ডাকি গো
        আমার বাঁধন দাও গো টুটে।
আমি      হাত বাড়িয়ে আছি
  আমায়     লও কেড়ে লও লুটে।
তুমি     ডাকো এমনি ডাকে
যেন      লজ্জা ভয় না থাকে,
যেন      সব ফেলে যাই, সব ঠেলে যাই,
           যাই ধেয়ে যাই ছুটে।
আমি     স্বপন দিয়ে বাঁধা,
কেবল      ঘুমের ঘোরের বাধা,
সে যে      জড়িয়ে আছে প্রাণের কাছে
            মুদিয়ে আঁখিপুটে;
ওগো      দিনের পরে দিন
আমার      কোথায় হল লীন,
কেবল      ভাষাহারা অশ্রুধারায়
           পরান কেঁদে উঠে।
আচ্ছা দাদাঠাকুর, তোমাকে আর কাঁদতে হয় না? তুমি যাঁর কথা বল তিনি তোমার চোখের জল মুছিয়েছেন?
দাদাঠাকুর। তিনি চোখের জল মোছান, কিন্তু চোখের জল ঘোচান না।
পঞ্চক। কিন্তু দাদা, আমি তোমার ঐ শোণপাংশুদের দেখি আর মনে ভাবি, ওরা চোখের জল ফেলতে শেখে নি। ওদের কি তুমি একেবারেই কাঁদাতে চাও না।
দাদাঠাকুর। যেখানে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে না সেখানে খাল কেটে জল আনতে হয়। ওদেরও রসের দরকার হবে, তখন দূর থেকে বয়ে আনবে। কিন্তু দেখেছি ওরা বর্ষণ চায় না, তাতে ওদের কাজ কামাই যায়, সে ওরা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না, ঐ রকমই ওদের স্বভাব।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমি তো সেই বর্ষণের জন্যে তাকিয়ে আছি। যতদূর শুকোবার তা শুকিয়েছে, কোথাও একটু সবুজ আর কিছু বাকি নেই, এইবার তো সময় হয়েছে—মনে হচ্ছে যেন দূর থেকে গুরু গুরু ডাক শুনতে পাচ্ছি। বুঝি এবার ঘন নীল মেঘে তপ্ত আকাশ জুড়িয়ে যাবে, ভরে যাবে।
গান
দাদাঠাকুর।                                             বুঝি এল, বুঝি এল, ওরে প্রাণ।
এবার ধর্ দেখি তোর গান।
ঘাসে ঘাসে খবর ছোটে
ধরা বুঝি শিউরে ওঠে,
দিগন্তে ওই স্তব্ধ আকাশ পেতে আছে কান।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমার বুকের মধ্যে কী আনন্দ যে লাগছে সে আমি বলে উঠতে পারি নে। এই মাটিকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। ডাকো ডাকো, তোমার একটা ডাক দিয়ে এই আকাশ ছেয়ে ফেলো।
গান
আজ     যেমন করে গাইছে আকাশ
            তেমন করে গাও গো।
        যেমন করে চাইছে আকাশ
            তেমনি করে চাও গো।
আজ      হাওয়া যেমন পাতায় পাতায়
            মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
         তেমনি আমার বুকের মাঝে
             কাঁদিয়া কাঁদাও গো।
শুনছ দাদা, ঐ কাঁসর বাজছে।
দাদাঠাকুর। হাঁ বাজছে।
পঞ্চক। আমার আর থাকবার জো নেই।
দাদাঠাকুর। কেন।
পঞ্চক। আজ আমাদের দীপকেতন পূজা।
দাদাঠাকুর। কী করতে হবে।
পঞ্চক। আজ ডুমুরতলা থেকে মাটি এনে সেইটে পঞ্চগব্য দিয়ে মেখে বিরোচন মন্ত্র পড়তে হবে। তার পরে সেই মাটিতে ছোটো ছোটো মন্দির গড়ে তার উপরে ধ্বজা বসিয়ে দিতে হবে। এমন হাজারটা গড়ে তবে সূর্যাস্তের পরে জলগ্রহণ।
দাদাঠাকুর। ফল কী হবে।
পঞ্চক। প্রেতলোকে পিতামহদের ঘর তৈরি হয়ে যাবে।
দাদাঠাকুর। যারা ইহলোকে আছে তাদের জন্যে—
পঞ্চক। তাদের জন্যে ঘর এত সহজে তৈরি হয় না। চললুম ঠাকুর, আবার কবে দেখা হবে জানি নে। তোমার এই হাতের স্পর্শ নিয়ে চললুম—এ-ই আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে—এ-ই আমার নাগপাশ-বাঁধন আলগা করে দেবে। ওই আসছে শোণপাংশুর দল—আমরা এখানে বসে আছি দেখে ওদের ভালো লাগছে না, ওরা ছট্ফট্ করছে। তোমাকে নিয়ে ওরা হুটোপাটি করতে চায়—করুক, ওরাই ধন্য, ওরা দিনরাত তোমাকে কাছে পায়।
দাদাঠাকুর। হুটোপাটি করলেই কি কাছে পাওয়া যায়। কাছে আসবার রাস্তাটা কাছের লোকের চোখেই পড়ে না।
শোণপাংশুদলের প্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। ও কী ভাই পঞ্চক, যাও কোথায়?
পঞ্চক। আমার সময় হয়ে গেছে, আমাকে যেতেই হবে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। বাঃ, সে কি হয়? আজ আমাদের বনভোজন, আজ তোমাকে ছাড়ছি নে।
পঞ্চক। না ভাই, সে হবে না— ঐ কাঁসর বাজছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। কিসের কাঁসর বাজছে?
পঞ্চক। তোরা বুঝবি নে। আজ দীপকেতন পূজা—আজ ছেলেমানুষি না। আমি চললুম। (কিছুদূর গিয়া হঠাৎ ছুটিয়া ফিরিয়া আসিয়া)
গান
      হারে রে রে রে রে—
আমায় ছেড়ে দে রে দে রে।
যেমন ছাড়া বনের পাখি
        মনের আনন্দে রে।
      ঘন শ্রাবণধারা
      যেমন বাঁধনহারা
বাদল বাতাস যেমন ডাকাত
আকাশ লুটে ফেরে।
      হারে রে রে রে রে
আমায়    রাখবে ধরে কে রে।
      দাবানলের নাচন যেমন
        সকল কানন ঘেরে।
      বজ্র যেমন বেগে
      গর্জে ঝড়ের মেঘে
অট্টহাস্যে সকল বিঘ্নবাধার বক্ষ চেরে।
প্রথম শোণপাংশু। বেশ বেশ পঞ্চকদাদা, তা হলে চলো আমাদের বনভোজনে।
পঞ্চক। বেশ, চলো। (একটু থামিয়া দ্বিধা করিয়া) কিন্তু ভাই, ওই বন পর্যন্তই যাব, ভোজন পর্যন্ত নয়।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। সে কি হয়! সকলে মিলে ভোজন না করলে আনন্দ কিসের!
পঞ্চক। না রে, তোদের সঙ্গে ঐ জায়গাটাতে আনন্দ চলবে না।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কেন চলবে না? চালালেই চলবে।
পঞ্চক। চালালেই চলে এমন কোনো জিনিস আমাদের ত্রিসীমানায় আসতে পারে না তা জানিস? মারলে চলে না, ঠেললে চলে না, দশটা হাতি জুড়ে দিলে চলে না, আর তুই বলিস কিনা চালালেই চলবে!
তৃতীয় শোণপাংশু। আচ্ছা ভাই, কাজ কী। তুমি বনেই চলো, আমাদের সঙ্গে খেতে বসতে হবে না।
পঞ্চক। খুব হবে রে খুব হবে। আজ খেতে বসবই, খাবই—আজ সকলের সঙ্গে বসেই খাব—আনন্দে আজ ক্রিয়াকল্পতরুর ডালে ডালে আগুন লাগিয়ে দেব—পুড়িয়ে সব ছাই করে ফেলব। দাদাঠাকুর, তুমি ওদের সঙ্গে খাবে না?
দাদাঠাকুর। আমি রোজই খাই।
পঞ্চক। তবে তুমি আমাকে খেতে বলছ না কেন।
দাদাঠাকুর। আমি কাউকে বলি নে ভাই, নিজে বসে যাই।
পঞ্চক। না দাদা, আমার সঙ্গে অমন করলে চলবে না। আমাকে তুমি হুকুম করো, তা হলে আমি বেঁচে যাই। আমি নিজের সঙ্গে কেবলই তর্ক করে মরতে পারি নে।
দাদাঠাকুর। অত সহজে তোমাকে বেঁচে যেতে দেব না পঞ্চক। যেদিন তোমার আপনার মধ্যে হুকুম উঠবে সেইদিন আমি হুকুম করব।
একদল শোণপাংশুর প্রবেশ
দাদাঠাকুর। কী রে, এত ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলি কেন?
প্রথম শোণপাংশু। চণ্ডককে মেরে ফেলেছে।
দাদাঠাকুর। কে মেরেছে?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। স্থবিরপত্তনের রাজা।
পঞ্চক। আমাদের রাজা? কেন, মারতে গেল কেন।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। স্থবিরক হয়ে ওঠবার জন্যে চণ্ডক বনের মধ্যে এক পোড়ো মন্দিরে তপস্যা করছিল। ওদের রাজা
মন্থরগুপ্ত সেই খবর পেয়ে তাকে কেটে ফেলেছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। আগে ওদের দেশের প্রাচীর পঁয়ত্রিশ হাত উঁচু ছিল, এবার আশি হাত উঁচু করবার জন্যে লোক লাগিয়ে দিয়েছে, পাছে পৃথিবীর সব লোক লাফ দিয়ে গিয়ে হঠাৎ স্থবিরক হয়ে ওঠে।
চতুর্থ শোণপাংশু। আমাদের দেশ থেকে দশজন শোণপাংশু ধরে নিয়ে গেছে, হয়তো ওদের কালঝন্টি দেবীর কাছে বলি দেবে।
দাদাঠাকুর। চলো তবে।
প্রথম শোণপাংশু। কোথায়।
দাদাঠাকুর। স্থবিরপত্তনে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। এখনই?
দাদাঠাকুর। হাঁ, এখনই।
সকলে। ওরে, চল্ রে চল্।
দাদাঠাকুর। আমাদের রাজার আদেশ আছে—ওদের পাপ যখন প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে তখন সেই প্রাচীর ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।
প্রথম শোণপাংশু। দেব ধুলোয় লুটিয়ে।
সকলে। দেব লুটিয়ে।
দাদাঠাকুর। ওদের সেই ভাঙা প্রাচীরের উপর দিয়ে রাজপথ তৈরি করে দেব।
সকলে। হাঁ, রাজপথ তৈরি করে দেব।
দাদাঠাকুর। আমাদের রাজার বিজয়রথ তার উপর দিয়ে চলবে।
সকলে। হাঁ, চলবে। চলবে।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, এ কী ব্যাপার!
দাদাঠাকুর। এই আমাদের বনভোজন।
প্রথম শোণপাংশু। চলো পঞ্চক, তুমি চলো।
দাদাঠাকুর। না না, পঞ্চক না। যাও ভাই, তুমি তোমার অচলায়তনে ফিরে যাও। যখন সময় হবে দেখা হবে।
পঞ্চক। কী জানি ঠাকুর, যদিও আমি কোনো কর্মেরই না, তবু ইচ্ছে করছে তোমাদের সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে পড়ি।
দাদাঠাকুর। না পঞ্চক, তোমার গুরু আসবেন, তুমি অপেক্ষা করো গে।
পঞ্চক। তবে ফিরে যাই। কিন্তু ঠাকুর, যতবার বাইরে এসে তোমার সঙ্গে দেখা হয় ততবার ফিরে গিয়ে অচলায়তনে আমাকে যেন আর ধরে না। হয় ওটাকে বড়ো করে দাও, নয় আমাকে আর বাড়তে দিয়ো না।
দাদাঠাকুর। আয় রে, তবে যাত্রা করি।

অচলায়তন
মহাপঞ্চক, উপাধ্যায়, সঞ্জীব, বিশ্বম্ভর, জয়োত্তম
বিশ্বম্ভর। আচার্য অদীনপুণ্য যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন তবে তিনি যেমন আছেন থাকুন, কিন্তু আমরা তাঁর কোনো অনুশাসন মানব না।
জয়োত্তম। তিনি বলেন, তাঁর গুরু তাঁকে যে আসনে বসিয়েছেন তাঁর গুরুই তাঁকে সেই আসন থেকে নামিয়ে দেবেন সেইজন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন।
একটি ছাত্রের প্রবেশ
মহাপঞ্চক। কী হে তৃণাঞ্জন।
তৃণাঞ্জন। আজ দ্বাদশী, আজ আমার লোকেশ্বর ব্রতের পারণের দিন। কিন্তু কী করব, আমাদের আচার্য যে কে তার তো কোনো ঠিক হল না—আমাদের যে সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ড পণ্ড হতে বসল এর কী করা যায়!
মহাপঞ্চক। সে তো আমি তোমাদের বলে রেখেছি—এখন আশ্রমে যা-কিছু কাজ হচ্ছে, সমস্তই নিষ্ফল হচ্ছে।
উপাধ্যায়। শুধু নিষ্ফল হচ্ছে তা নয়, আমাদের অপরাধ ক্রমেই জমে উঠছে।
সঞ্জীব। এ যে বড়ো সর্বনেশে কথা।
জয়োত্তম। কিন্তু আমাদের গুরু আসবার তো দেরি নেই, এর মধ্যে আর কত অনিষ্টই বা হবে।
সঞ্জীব। আরে রাখো তোমার তর্ক। অনিষ্ট হতে সময় লাগে না। মরার পক্ষে এক মুহূর্তই যথেষ্ট।
অধ্যেতার প্রবেশ
উপাধ্যায়। কী গো অধ্যেতা, ব্যাপার কী।
অধ্যেতা। তোমরা তো আমাকে বলে এলে সুভদ্রকে মহাতামসে বসাতে—কিন্তু বসায় কার সাধ্য।
মহাপঞ্চক। কেন, কী বিঘ্ন ঘটেছে।
অধ্যেতা। মূর্তিমান বিঘ্ন রয়েছে তোমার ভাই!
মহাপঞ্চক। পঞ্চক?
অধ্যেতা। হাঁ। আমি সুভদ্রকে হিঙ্গুমর্দন কুণ্ডে স্নান করিয়ে সবে উঠেছি এমন সময় পঞ্চক এসে তাকে কেড়ে নিয়ে গেল।
মহাপঞ্চক। না, এই নরাধমকে নিয়ে আর চলল না। অনেক সহ্য করেছি। এবার ওকে নির্বাসন দেওয়াই স্থির। কিন্তু অধ্যেতা, তুমি এটা সহ্য করলে?
অধ্যেতা। আমি কি তোমার পঞ্চককে ভয় করি! স্বয়ং আচার্য অদীনপুণ্য এসে তাকে আদেশ করলেন, তাই তো সে সাহস পেলে।
তৃণাঞ্জন। আচার্য অদীনপুণ্য!
সঞ্জীব। স্বয়ং আমাদের আচার্য!
বিশ্বম্ভর। ক্রমে এ-সব হচ্ছে কী! এতদিন এই আয়তনে আছি, কখনো তো এমন অনাচারের কথা শুনি নি। যে স্নাত তাকে তার ব্রত থেকে ছিন্ন করে আনা! আর স্বয়ং আমাদের আচার্যের এই কীর্তি!
জয়োত্তম। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেই দেখা যাক-না।
বিশ্বম্ভর। না না, আচার্যকে আমরা—
মহাপঞ্চক। কী করবে আচার্যকে, বলেই ফেলো।
বিশ্বম্ভর। তাই তো ভাবছি কী করা যায়। তাকে না হয়—আপনি বলে দিন না কী করতে হবে।
মহাপঞ্চক। আমি বলছি তাঁকে সংযত করে রাখতে হবে।
সঞ্জীব। কেমন করে?
মহাপঞ্চক। কেমন করে আবার কী! মত্ত হস্তীকে যেমন করে সংযত করতে হয় তেমনি করে।
জয়োত্তম। আমাদের আচার্যদেবকে কি তা হলে—
মহাপঞ্চক। হাঁ, তাঁকে বন্ধ করে রাখতে হবে। চুপ করে রইলে যে! পারবে না?
তৃণাঞ্জন। কেন পারব না। আপনি যদি আদেশ করেন তা হলেই—
জয়োত্তম। কিন্তু শাস্ত্রে কি এর—
মহাপঞ্চক। শাস্ত্রে বিধি আছে।
তৃণাঞ্জন। তবে আর ভাবনা কী?
উপাধ্যায়। মহাপঞ্চক, তোমার কিছুই বাধে না, আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে।
আচার্যের প্রবেশ
আচার্য। বৎস, এতদিন তোমরা আমাকে আচার্য বলে মেনেছ, আজ তোমাদের সামনে আমার বিচারের দিন এসেছে। আমি স্বীকার করছি অপরাধের অন্ত নেই, অন্ত নেই, তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে।
তৃণাঞ্জন। তবে আর দেরি করেন কেন। এদিকে যে আমাদের সর্বনাশ হয়।
জয়োত্তম। দেখো তৃণাঞ্জন, আস্তাকুঁড়ের ছাই দিয়ে তোমার এই মুখের গর্তটা ভরিয়ে দিতে হবে। একটু থামো না।
আচার্য। গুরু চলে গেলেন, আমরা তাঁর জায়গায় পুঁথি নিয়ে বসলুম; তার শুকনো পাতায় ক্ষুধা যতই মেটে না ততই পুঁথি কেবল বাড়াতে থাকি। খাদ্যের মধ্যে প্রাণ যতই কমে তার পরিমাণ ততই বেশি হয়। সেই জীর্ণ পুঁথির ভাণ্ডারে প্রতিদিন তোমরা দলে দলে আমার কাছে তোমাদের তরুণ হৃদয়টি মেলে ধরে কী চাইতে এসেছিলে! অমৃতবাণী? কিন্তু আমার তালু যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! রসনায় যে রসের লেশমাত্র নেই! এবার নিয়ে এসো সেই বাণী, গুরু, নিয়ে এসো হৃদয়ের বাণী। প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও।
পঞ্চক। (ছুটিয়া প্রবেশ করিয়া) তোমার নববর্ষার সজল হাওয়ায় উড়ে যাক সব শুকনো পাতা—আয় রে নবীন কিশলয়—তোরা ছুটে আয়, তোরা ফুটে বেরো। ভাই জয়োত্তম, শুনছ না, আকাশের ঘন নীল মেঘের মধ্যে মুক্তির ডাক উঠেছে—‘আজ নৃত্য কর্ রে নৃত্য কর্'।
গান
ওরে ওরে     ওরে আমার মন মেতেছে
তারে আজ থামায় কে রে!
সে যে      আকাশ পানে হাত পেতেছে,
                তারে আজ নামায় কে রে!
প্রথম জয়োত্তমের, পরে বিশ্বম্ভরের, পরে সঞ্জীবের নৃত্যগীতে যোগ
মহাপঞ্চক। পঞ্চক, নির্লজ্জ বানর কোথাকার, থাম্ বলছি, থাম্।
গান
পঞ্চক।                                        ওরে,     আমার মন মেতেছে
              আমারে থামায় কে রে।
মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, আমি তোমাকে বলি নি একজটা দেবীর শাপ আরম্ভ হয়েছে? দেখছ, কী করে তিনি আমাদের সকলের বুদ্ধিকে বিচলিত করে তুলছেন—ক্রমে দেখবে অচলায়তনের একটি পাথরও আর থাকবে না।
পঞ্চক। না থাকবে না, থাকবে না, পাথরগুলো সব পাগল হয়ে যাবে; তারা কে কোথায় ছুটে বেরিয়ে পড়বে, তারা গান ধরবে—
ওরে ভাই,       নাচ্ রে ও ভাই নাচ্ রে—
আজ            ছাড়া পেয়ে বাঁচ্ রে-
লাজ ভয়     ঘুচিয়ে দে রে।
তোরে আজ থামায় কে রে!
মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী! সর্বনাশ শুরু হয়েছে, বুঝতে পারছ না! ওরে সব ছন্নমতি মূর্খ, অভিশপ্ত বর্বর, আজ তোদের নাচবার দিন?
পঞ্চক। সর্বনাশের বাজনা বাজলেই নাচ শুরু হয় দাদা।
মহাপঞ্চক। চুপ কর্ লক্ষ্মীছাড়া! ছাত্রগণ, তোমরা আত্মবিসমৃত হোয়ো না। ঘোর বিপদ আসন্ন সে কথা স্মরণ রেখো।
বিশ্বম্ভর। আচার্যদেব, পায়ে ধরি, সুভদ্রকে আমাদের হাতে দিন, তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত থেকে নিরস্ত করবেন না।
আচার্য। না বৎস, এমন অনুরোধ কোরো না।
সঞ্জীব। ভেবে দেখুন, সুভদ্রের কতবড়ো ভাগ্য। মহাতামস কজন লোকে পারে। ও যে ধরাতলে দেবত্ব লাভ করবে।
আচার্য। গায়ের জোরে দেবতা গড়বার পাপে আমাকে লিপ্ত কোরো না। সে মানুষ, সে শিশু, সেইজন্যই সে দেবতাদের প্রিয়।
তৃণাঞ্জন। দেখুন, আপনি আমাদের আচার্য, আমাদের প্রণম্য, কিন্তু যে অন্যায় আজ করছেন, তাতে আমরা বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হব।
আচার্য। করো, বলপ্রয়োগ করো, আমাকে মেনো না, আমাকে মারো, আমি অপমানেরই যোগ্য, তোমাদের হাত দিয়ে আমার যে শাস্তি আরম্ভ হল তাতেই বুঝতে পারছি গুরুর আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু সেইজন্যেই বলছি শাস্তির কারণ আর বাড়তে দেব না। সুভদ্রকে তোমাদের হাতে দিতে পারব না।
তৃণাঞ্জন। পারবেন না?
আচার্য। না।
মহাপঞ্চক। তা হলে আর দ্বিধা করা নয়। তৃণাঞ্জন, এখন তোমাদের উচিত ওঁকে জোর করে ধরে নিয়ে ঘরে বন্ধ করা। ভীরু, কেউ সাহস করছ না? আমাকেই তবে এ কাজ করতে হবে?
জয়োত্তম। খবরদার—আচার্যদেবের গায়ে হাত দিতে পারবে না।
বিশ্বম্ভর। না না, মহাপঞ্চক, ওঁকে অপমান করলে আমরা সইতে পারব না।
সঞ্জীব। আমরা সকলে মিলে পায়ে ধরে ওঁকে রাজি করাব। একা সুভদ্রের প্রতি দয়া করে উনি কি আমাদের সকলের অমঙ্গল ঘটাবেন?
তৃণাঞ্জন। এই অচলায়তনের এমন কত শিশু উপবাসে প্রাণত্যাগ করেছে—তাতে ক্ষতি কী হয়েছে!
সুভদ্রের প্রবেশ
সুভদ্র। আমাকে মহাতামস ব্রত করাও।
পঞ্চক। সর্বনাশ করলে! ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আমি এখানে এসেছিলুম, কখন জেগে চলে এসেছে।
আচার্য। বৎস সুভদ্র, এসো আমার কোলে। যাকে পাপ বলে ভয় করছ সে পাপ আমার—আমিই প্রায়শ্চিত্ত করব।
তৃণাঞ্জন। না না, আয় রে সুভদ্র, তুই মানুষ না, তুই দেবতা।
সঞ্জীব। তুই ধন্য।
বিশ্বম্ভর। তোর বয়সে মহাতামস করা আর কারো ভাগ্যে ঘটে নি। সার্থক তোর মা তোকে গর্ভে ধারণ করেছিল।
উপাধ্যায়। আহা সুভদ্র, তুই আমাদের অচলায়তনেরই বালক বটে।
মহাপঞ্চক। আচার্য, এখনো কি তুমি জোর করে এই বালককে এই মহাপুণ্য থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছ?
আচার্য। হায় হায়, এই দেখেই তো আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যদি ওকে কাঁদিয়ে আমার হাত থেকে ছিঁড়ে কেড়ে নিয়ে যেতে তা হলেও আমার এত বেদনা হত না। কিন্তু দেখছি হাজার বছরের নিষ্ঠুর বাহু অতটুকু শিশুর মনকেও পাথরের মুঠোয় চেপে ধরেছে, একেবারে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রে। কখন সময় পেল সে? সে কি গর্ভের মধ্যেও কাজ করে!
পঞ্চক। সুভদ্র, আয় ভাই, প্রায়শ্চিত্ত করতে যাই—আমিও যাব তোর সঙ্গে।
আচার্য। বৎস, আমিও যাব।
সুভদ্র। না না, আমাকে যে একলা থাকতে হবে—লোক থাকলে যে পাপ হবে!
মহাপঞ্চক। ধন্য শিশু, তুমি তোমার ঐ প্রাচীন আচার্যকে আজ শিক্ষা দিলে। এসো তুমি আমার সঙ্গে।
আচার্য। না, আমি যতক্ষণ তোমাদের আচার্য আছি ততক্ষণ আমার আদেশ ব্যতীত কোনো ব্রত আরম্ভ বা শেষ হতেই পারে না। আমি নিষেধ করছি। সুভদ্র, আচার্যের কথা অমান্য কোরো না—এসো পঞ্চক, ওকে কোলে করে নিয়ে এসো।
[ সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের ও আচার্যের এবং উপাধ্যায়ের প্রস্থান
মহাপঞ্চক। ধিক্। তোমাদের মতো ভীরুদের দুর্গতি হতে রক্ষা করে এমন সাধ্য কারও নেই। তোমরা নিজেও মরবে অন্য সকলকেও মারবে। তোমাদের উপাধ্যায়টিও তেমনি হয়েছেন—তাঁরও আর দেখা নেই।
পদাতিকের প্রবেশ
পদাতিক। রাজা আসছেন।
মহাপঞ্চক। ব্যাপারখানা কী! এ যে আমাদের রাজা মন্থরগুপ্ত।
রাজার প্রবেশ
রাজা। নরদেবগণ, তোমাদের সকলকে নমস্কার।
সকলে। জয়োস্তু রাজন্।
মহাপঞ্চক। কুশল তো?
রাজা। অত্যন্ত মন্দ সংবাদ। প্রত্যন্তদেশের দূতেরা এসে খবর দিল যে দাদাঠাকুরের দল এসে আমাদের রাজ্যসীমার প্রাচীর ভাঙতে আরম্ভ করেছে।
মহাপঞ্চক। দাদাঠাকুরের দল কারা?
রাজা। ঐ যে শোণপাংশুরা।
মহাপঞ্চক। শোণপাংশুরা যদি আমাদের প্রাচীর ভাঙে তা হলে যে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দেবে।
রাজা। সেইজন্যেই তো ছুটে এলুম। তোমাদের কাছে আমার প্রশ্ন এই যে, আমাদের প্রাচীর ভাঙল কেন?
মহাপঞ্চক। শিখাসচ্ছন্দ মহাভৈরব তো আমাদের প্রাচীর রক্ষা করছেন।
রাজা। তিনি অনাচারী শোণপাংশুদের কাছে আপন শিখা নত করলেন! নিশ্চয়ই তোমাদের মন্ত্র-উচ্চারণ অশুদ্ধ হচ্ছে, তোমাদের ক্রিয়াপদ্ধতিতে স্খলন হচ্ছে, নইলে এ যে স্বপ্নের অতীত।
মহাপঞ্চক। আপনি সত্যই অনুমান করেছেন মহারাজ।
সঞ্জীব। একজটা দেবীর শাপ তো আর ব্যর্থ হতে পারে না।
রাজা। একজটা দেবীর শাপ! সর্বনাশ! কেন তাঁর শাপ।
মহাপঞ্চক। যে উত্তরদিকে তাঁর অধিষ্ঠান এখানে একদিন সেই দিককার জানলা খোলা হয়েছে।
রাজা। (বসিয়া পড়িয়া) তবে তো আর আশা নেই।
মহাপঞ্চক। আচার্য অদীনপুণ্য এ-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিচ্ছেন না।
তৃণাঞ্জন। তিনি জোর করে আমাদের ঠেকিয়ে রেখেছেন।
রাজা। তবে তো মিথ্যা আমি সৈন্য জড়ো করতে বলে এলুম। দাও, দাও, অদীনপুণ্যকে এখনই নির্বাসিত করে দাও।
মহাপঞ্চক। আগামী অমাবস্যায়—
রাজা। না না, এখন তিথিনক্ষত্র দেখবার সময় নেই। বিপদ আসন্ন। সংকটের সময় আমি আমার রাজ-অধিকার খাটাতে পারি—শাস্ত্রে তার বিধান আছে।
মহাপঞ্চক। হাঁ আছে। কিন্তু আচার্য কে হবে?
রাজা। তুমি, তুমি। এখনই আমি তোমাকে আচার্যের পদে প্রতিষ্ঠিত করে দিলুম। দিক্পালগণ সাক্ষী রইলেন, এই ব্রহ্মচারীরা সাক্ষী রইলেন।
মহাপঞ্চক। অদীনপুণ্যকে কোথায় নির্বাসিত করতে চান?
রাজা। আয়তনের বাহিরে নয়—কী জানি যদি শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দেন। আমার পরামর্শ এই যে, আয়তনের প্রান্তে যে দর্ভকদের পাড়া আছে এ-কয়দিন সেইখানে তাঁকে বদ্ধ করে রেখো।
জয়োত্তম। আচার্য অদীনপুণ্যকে দর্ভকদের পাড়ায়! তারা যে অন্ত্যজ পতিত জাতি।
মহাপঞ্চক। যিনি স্পর্ধাপূর্বক আচার লঙ্ঘন করেন, অনাচারীদের মধ্যে বাস করলেই তবে তাঁর চোখ ফুটবে। মনে কোরো না আমার ভাই বলে পঞ্চককে ক্ষমা করব—তারও সেইখানে গতি।
রাজা। দেখো মহাপঞ্চক, তোমার উপরই নির্ভর, যুদ্ধে জেতা চাই। আমার হার যদি হয় তবে সে তোমাদের অচলায়তনেরই অক্ষয় কলঙ্ক।
মহাপঞ্চক। কোনো ভয় করবেন না।

দর্ভকপল্লী
পঞ্চক। নির্বাসন, আমার নির্বাসন রে! বেঁচে গেছি, বেঁচে গেছি। কিন্তু এখনও মনটাকে তার খোলসের ভিতর থেকে টেনে বের করতে পারছি নে কেন!
গান
এই      মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে রে।
তোরা আমায় বলে দে ভাই বলে দে রে।
ফুলের গোপন পরানমাঝে
নীরব সুরে বাঁশি বাজে—
ওদের     সেই বাঁশিতে কেমনে মন হরেছে রে।
যে মধুটি লুকিয়ে আছে
দেয় না ধরা কারো কাছে
ওদের       সেই মধুতে কেমনে মন ভরেছে রে।
দর্ভকদলের প্রবেশ
প্রথম দর্ভক। দাদাঠাকুর।
পঞ্চক। ও কী ও। দাদাঠাকুর বলছিস কাকে? আমার গায়ে দাদাঠাকুর নাম লেখা হয়ে গেছে নাকি?
প্রথম দর্ভক। তোমাদের কী খেতে দেব ঠাকুর?
পঞ্চক। তোদের যা আছে তাই আমরা খাব।
দ্বিতীয় দর্ভক। আমাদের খাবার? সে কি হয়? সে যে সব ছোঁওয়া হয়ে গেছে।
পঞ্চক। সেজন্যে ভাবিস নে ভাই। পেটের খিদে যে আগুন, সে কারও ছোঁওয়া মানে না, সবই পবিত্র করে। ওরে, তোরা সকালবেলায় করিস কী বল্ তো। ষড়ক্ষরিত দিয়ে একবার ঘটশুদ্ধি করে নিবি নে?
তৃতীয় দর্ভক। ঠাকুর, আমরা নীচ দর্ভকজাত—আমরা ওসব কিছুই জানি নে। আজ কতপুরুষ ধরে এখানে বাস করে আসছি, কোনোদিন তো তোমাদের পায়ের ধুলা পড়ে নি। আজ তোমাদের মন্ত্র পড়ে আমাদের বাপ পিতামহকে উদ্ধার করে দাও ঠাকুর।
পঞ্চক। সর্বনাশ! বলিস কী! এখানেও মন্ত্র পড়তে হবে! তাহলে নির্বাসনের দরকার কী ছিল? তা, সকালবেলা তোরা কী করিস বল্ তো?
প্রথম দর্ভক। আমরা শাস্ত্র জানি নে, আমরা নামগান করি।
পঞ্চক। সে কী রকম ব্যাপার? শোনা দেখি একটা।
দ্বিতীয় দর্ভক। ঠাকুর, সে শুনে তুমি হাসবে।
পঞ্চক। আমিই তো ভাই এতদিন লোক হাসিয়ে আসছি—তোরা আমাকেও হাসাবি! শুনেও মন খুশি হয়। আমি যে কী
মূল্যের মানুষ সে তোরা খবর পাস নি বলে এখনো আমার হাসিকে ভয় করিস। কিছু ভাবিস নে-নির্ভয়ে শুনিয়ে দে।
প্রথম দর্ভক। আচ্ছা ভাই আয় তবে—গান ধর।
গান
ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি,
ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি!
ও নয়নের আলো, ও রসনার মধু,
ও রতনের হার, ও পরানের বঁধূ!
ও অপরূপ রূপ, ও মনোহর কথা,
ও চরমের সুখ, ও মরমের ব্যথা!
ও ভিখারির ধন, ও অবলার বোল –
ও জনমের দোলা, ও মরণের কোল!
পঞ্চক। দে ভাই, আমার মন্ত্রতন্ত্র সব ভুলিয়ে দে, আমার বিদ্যাসাধ্যি সব কেড়ে নে, দে আমাকে তোদের ঐ গান শিখিয়ে দে।
প্রথম দর্ভক। আমাদের গান?
পঞ্চক। হাঁ রে হাঁ, ঐ অধমের গান, অক্ষমের কান্না। তোদের এই মূর্খের বিদ্যা এই কাঙালের সম্বল খুঁজেই তো আমার পড়াশুনা কিছু হল না, আমার ক্রিয়াকর্ম সমস্ত নিষ্ফল হয়ে গেল! ও ভাই, আর-একটা শোনা—অনেক দিনকার তৃষ্ণা অল্পে মেটে না।
দর্ভকদলের গান
আমরা     তারেই জানি তারেই জানি সাথের সাথি।
তারেই করি টানাটানি দিবারাতি।
        সঙ্গে তারি চরাই ধেনু,
            বাজাই বেণু,
তারি লাগি বটের ছায়ায় আসন পাতি।
        তারে হালের মাঝি করি
            চালাই তরী,
ঝড়ের বেলায় ঢেউয়ের খেলায় মাতামাতি।
        সারাদিনের কাজ ফুরালে
            সন্ধ্যাকালে
তাহারি পথ চেয়ে ঘরে জ্বালাই বাতি।
আচার্যের প্রবেশ
আচার্য। সার্থক হল আমার নির্বাসন।
প্রথম দর্ভক। বাবাঠাকুর, আমাদের সমস্ত পাড়া আজ ত্রাণ পেয়ে গেল। এতদিন তোমার চরণধুলো তো এখানে পড়ে নি।
আচার্য। সে আমার অভাগ্য, সে আমারই অভাগ্য।
দ্বিতীয় দর্ভক। বাবা, তোমার স্নানের জল কাকে দিয়ে তোলাব। এখানে তো—
আচার্য। বাবা, তোরাই তুলে আনবি।
প্রথম দর্ভক। আমরা তুলে আনব!সে কি হয়!
আচার্য। হাঁ বাবা, তোদের তোলা জলে আজ আমার অভিষেক হবে।
দ্বিতীয় দর্ভক। ওরে চল্ তবে ভাই, চল্। আমাদের পাটলা নদী থেকে জল আনি গে।
[ প্রস্থান
আচার্য। দেখো পঞ্চক, কাল এখানে এসে আমার ভারি গ্লানি বোধ হচ্ছিল।
পঞ্চক। আমি তো কাল রাত্রে ঘরের বাইরে শুয়েই কাটিয়ে দিয়েছি।
আচার্য। যখন এইরকম অত্যন্ত কুন্ঠিত হয়ে আপনাকে আদ্যোপান্ত পাপলিপ্ত মনে করে বসে আছি এমন সময় ওরা সন্ধ্যাবেলায় ওদের কাজ থেকে ফিরে এসে সকলে মিলে গান ধরলে—
পারের কাণ্ডারী গো, এবার ঘাট কি দেখা যায়?
নামবে কি সব বোঝা এবার, ঘুচবে কি সব দায়?
শুনতে শুনতে মনে হল আমার যেন একটা পাথরের দেহ গলে গেল। দিনের পর দিন কী ভার বয়েই বেড়িয়েছি। কিন্তু কতই সহজ সরল প্রাণ নিয়ে সেই পারের কাণ্ডারীর খেয়ায় চড়ে বসা!
পঞ্চক। আমি দেখছি দর্ভক জাতের একটা গুণ—ওরা একেবারে স্পষ্ট করে নাম নিতে জানে। আর তট তট তোতয় তোতয় করতে করতে আমার জিবের এমনি দশা হয়েছে যে, সহজ কথাটা কিছুতেই মুখ দিয়ে বেরোতে চায় না। আচার্যদেব, কেবল ভালো করে না ডাকতে পেরেই আমাদের বুকের ভিতরটা এমন শুকিয়ে এসেছে, একবার খুব করে গলা ছেড়ে ডাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু গলা খোলে না যে—রাজ্যের পুঁথি পড়ে পড়ে গলা বুজে গিয়েছে প্রভু। এমন হয়েছে আজ কান্না এলেও বেধে যায়।
আচার্য। সেইজন্যেই তো ভাবছি আমাদের গুরু আসবেন কবে। জঞ্জাল সব ঠেলে ফেলে দিয়ে আমাদের প্রাণটাকে একেবারে সরল করে দিন—হাতে করে ধরে সকলের সঙ্গে মিল করিয়ে দিন।
পঞ্চক। মনে হচ্ছে যেন ভিজে মাটির গন্ধ পাচ্ছি, কোথায় যেন বর্ষা নেমেছে।
আচার্য। ঐ, পঞ্চক শুনতে পাচ্ছ কি?
পঞ্চক। কী বলুন দেখি?
আচার্য। আমার মনে হচ্ছে যেন সুভদ্র কাঁদছে।
পঞ্চক। এখান থেকে কি শোনা যাবে? এ বোধ হয় আর-কোনো শব্দ।
আচার্য। তা হবে পঞ্চক, আমি তার কান্না আমার বুকের মধ্যে করে এনেছি তার কান্নাটা এমন করে আমাকে বেজেছে কেন জান? সে যে কান্না রাখতে পারে না তবু কিছুতে মানতে চায় না সে কাঁদছে।
পঞ্চক। এতক্ষণে ওরা তাকে মহাতামসে বসিয়েছে—আর সকলে মিলে খুব দূরে থেকে বাহবা দিয়ে বলছে সুভদ্র দেবশিশু। আর কিছু না, আমি যদি রাজা হতুম তা হলে ওদের সবাইকে কানে ধরে দেবতা করে দিতুম—কিছুতে ছাড়তুম না।
আচার্য। ওরা ওদের দেবতাকে কাঁদাচ্ছে পঞ্চক। সেই দেবতারই কান্নায় এ রাজ্যের সকল আকাশ আকুল হয়ে উঠেছে। তবু
ওদের পাষাণের বেড়া এখনো শতধা বিদীর্ণ হয়ে গেল না।
পঞ্চক। প্রভু, আমরা তাঁকে সকলে মিলে কত কাঁদালুম তবু তাড়াতে পারলুম না। তাঁকে যে-ঘরে বসালুম সে-ঘরের আলো সব নিবিয়ে দিলুম—তাঁকে আর দেখতে পাই নে—তবু তিনি সেখানে বসে আছেন।
গান
সকল জনম ভ'রে
     ও মোর দরদিয়া—
কাঁদি কাঁদাই তোরে
     ও মোর দরদিয়া!
     আছ হৃদয়মাঝে,
সেথা      কতই ব্যথা বাজে
ওগো      এ কি তোমায় সাজে
             ও মোর দরদিয়া!
এই      দুয়ার-দেওয়া ঘরে
কভু      আঁধার নাহি সরে,
তবু       আছ তারি পরে
              ও মোর দরদিয়া!
সেথা       আসন হয় নি পাতা,
সেথা      মালা হয় নি গাঁথা;
আমার      লজ্জাতে হেঁট মাথা
             ও মোর দরদিয়া।

উপাচার্যের প্রবেশ
আচার্য। একি সূতসোম! আমার কী সৌভাগ্য। কিন্তু তুমি এখানে এলে যে?
উপাচার্য। আর কোথা যাব বলো। তুমি চলে আসামাত্র অচলায়তন যে কী কঠিন হয়ে উঠল, কী শুকিয়ে গেল সে আমি বলতে পারি নে। এখন এসো একবার কোলাকুলি করি।
আচার্য। আমাকে ছুঁয়ো না—কাল থেকে ঘটশুদ্ধি ভূতশুদ্ধি কিছুই করি নি।
উপাচার্য। তা হোক তা হোক। তোমারও আলিঙ্গন যদি অশুচি হয় তবে সেই অশুচিতার পুণ্যদীক্ষাই আমাকে দাও।
কোলাকুলি
পঞ্চক। উপাচার্যদেব, অচলায়তনে তোমার কাছে যত অপরাধ করেছি আজ এই দর্ভকপাড়ায় সে-সমস্ত ক্ষমা করে নাও।
উপাচার্য। এসো বৎস, এসো।
আলিঙ্গন
আচার্য। সূতসোম, গুরু তো শীঘ্রই আসছেন, এখন তুমি সেখান থেকে চলে এলে কী করে।
উপাচার্য। সেইজন্যেই চলে এলুম। গুরু আসছেন, তুমি নেই! আর মহাপঞ্চক এসে গুরুকে বরণ করে নেবে—এও দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে হবে। ওই শাস্ত্রের কীটটা গুরুকে আহ্বান করে আনবার যোগ্য এমন কথা যদি স্বয়ং মহামহর্ষি জলধরগর্জিতঘোষ-সুস্বরনক্ষত্রশঙ্কুসুমিত এসেও বলেন তবু আমি মানতে পারব না।
পঞ্চক। আঃ দেখতে দেখতে কী মেঘ করে এল। শুনছ আচার্যদেব, বজ্রের পর বজ্র! আকাশকে একেবারে দিকে দিকে দগ্ধ করে দিলে যে!
আচার্য। ঐ-যে নেমে এল বৃষ্টি—পৃথিবীর কতদিনের পথ-চাওয়া বৃষ্টি—অরণ্যের কত রাতের স্বপ্নদেখা বৃষ্টি।
পঞ্চক। মিটল এবার মাটির তৃষ্ণা—এই যে কালো মাটি—এই যে সকলের পায়ের নিচেকার মাটি।
ডালিতে কেয়াফুল কদম্বফুল লইয়া বাদ্যসহ দর্ভকদলের প্রবেশ
আচার্য। বাবা, তোমাদের এ কী সমারোহ!আজ এ কী কাণ্ড!
প্রথম দর্ভক। বাবাঠাকুর, আজ তোমাদের নিয়েই সমারোহ। কখনো পাই নে, আজ পেয়েছি।
দ্বিতীয় দর্ভক। আমরা তো শাস্ত্র কিছুই জানি নে—তোমাদের দেবতা আমাদের ঘরে আসে না।
তৃতীয় দর্ভক। কিন্তু আজ দেবতা কী মনে করে অতিথি হয়ে এই অধমদের ঘরে এসেছেন।
প্রথম দর্ভক। তাই আমাদের যা আছে তাই দিয়ে তোমাদের সেবা করে নেব।
দ্বিতীয় দর্ভক। আমাদের মন্ত্র নেই বলে আমরা শুধু কেবল গান গাই।
মাদল বাজাইয়া নৃত্যগীত
উতল ধারা বাদল ঝড়ে,
সকল বেলা একা ঘরে।
সজল হাওয়া বহে বেগে,
পাগল নদী উঠে জেগে,
আকাশ ঘেরে কাজল মেঘে,
তমালবনে আঁধার করে।
ওগো বঁধু দিনের শেষে
এলে তুমি কেমন বেশে।
আঁচল দিয়ে শুকাব জল
মুছাব পা আকুল কেশে।
নিবিড় হবে তিমির রাতি,
জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,
পরানখানি দিব পাতি
চরণ রেখো তাহার ’পরে।
আচার্য। পঞ্চক, আমাদেরও এমনি করে ডাকতে হবে—বজ্ররবে যিনি দরজায় ঘা দিয়েছেন তাঁকে ঘরে ডেকে নাও—আর দেরি কোরো না।
ভুলে গিয়ে জীবন মরণ
লব তোমায় করে বরণ,
করিব জয় শরমত্রাসে
দাঁড়াব আজ তোমার পাশে
বাঁধন বাধা যাবে জ্বলে,
সুখদুঃখ দেব দলে,
ঝরের রাতে তোমার সাথে
   বাহির হব অভয় ভরে।
সকলে।                                                 উতল ধারা বাদল ঝরে—
দুয়ার খুলে এলে ঘরে।
চোখে আমার ঝলক লাগে,
সকল মনে পুলক জাগে,
চাহিতে চাই মুখের বাগে
    নয়ন মেলে কাঁপি ডরে।
পঞ্চক। ঐ আবার বজ্র।
আচার্য। দ্বিগুন বেগে বৃষ্টি এল।
উপাচার্য। আজ সমস্ত রাত এমনি করেই কাটবে।

অচলায়তন
মহাপঞ্চক, তৃণাঞ্জন, সঞ্জীব, বিশ্বম্ভর, জয়োত্তম
মহাপঞ্চক। তোমরা অত ব্যস্ত হয়ে পড়ছ কেন!কোনো ভয় নেই।
তৃণাঞ্জন। তুমি তো বলছ ভয় নেই, এই যে খবর এল শত্রুসৈন্য অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দিয়েছে।
মহাপঞ্চক। এ-কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শিলা জলে ভাসে! ম্লেচ্ছরা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দেবে! পাগল হয়েছ!
সঞ্জীব। কে যে বললে দেখে এসেছে।
মহাপঞ্চক। সে স্বপ্ন দেখেছে।
জয়োত্তম। আজই তো আমাদের গুরুর আসবার কথা।
মহাপঞ্চক। তাঁর জন্যে সমস্ত আয়োজন ঠিক হয়ে গেছে; কেবল যে-ছেলের মা-বাপ ভাই-বোন কেউ মরে নি এমন নবম গর্ভের সন্তান এখনও জুটিয়ে আনতে পারলে না—দ্বারে দাঁড়িয়ে কে যে মহারক্ষা পড়বে ঠিক করতে পারছি নে।
সঞ্জীব। গুরু এলে তাঁকে চিনে নেবে কে। আচার্য অদীনপুণ্য তাঁকে জানতেন। আমরা তো কেউ তাঁকে দেখি নি।
মহাপঞ্চক। আমাদের আয়তনে যে শাঁক বাজায় সেই বৃদ্ধ তাঁকে দেখেছে। আমাদের পূজার ফুল যে জোগায় সেও তাঁকে জানে।
বিশ্বম্ভর। ঐ-যে উপাধ্যায় ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছেন।
মহাপঞ্চক। নিশ্চয় গুরু আসবার সংবাদ পেয়েছেন। কিন্তু মহারক্ষা-পাঠের কী করা যায়! ঠিক লক্ষণসম্পন্ন ছেলে তো পাওয়া গেল না।
উপাধ্যায়ের প্রবেশ
মহাপঞ্চক। কতদূর।
উপাধ্যায়। কতদূর কী! এসে পড়েছে যে!
মহাপঞ্চক। কই দ্বারে তো এখনও শাঁক বাজালে না।
উপাধ্যায়। বিশেষ দরকার দেখি নে—কারণ দ্বারের চিহ্নও দেখতে পাচ্ছি নে—ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
মহাপঞ্চক। বল কী! দ্বার ভেঙেছে?
উপাধ্যায়। শুধু দ্বার নয়, প্রাচীরগুলোকে এমনি সমান করে শুইয়ে দিয়েছে যে তাদের সম্বন্ধে আর কোনো চিন্তা করবার দরকার নেই।
মহাপঞ্চক। কিন্তু আমাদের দৈবজ্ঞ যে গণনা করে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়ে গেল যে—
উপাধ্যায়। তার চেয়ে ঢের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শত্রুসৈন্যদের রক্তবর্ণ টুপিগুলো।
ছাত্রগণ। কী সর্বনাশ!
সঞ্জীব। কিসের মন্ত্র তোমার মহাপঞ্চক!
তৃণাঞ্জন। আমি তো তখনই বলেছিলুম এ-সব কাজ এই কাঁচাবয়সের পুঁথিপড়া অকালপক্কদের দিয়ে হবার নয়।
বিশ্বম্ভর। কিন্তু এখন করা যায় কী?
তৃণাঞ্জন। আমাদের আচার্যদেবকে এখনই ফিরিয়ে আনি গে। তিনি থাকলে এ বিপত্তি ঘটতেই পারত না। হাজার হোক লোকটা পাকা।
সঞ্জীব। কিন্তু দেখো মহাপঞ্চক, আমাদের আয়তনের যদি কোনো বিপত্তি ঘটে তা হলে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।
উপাধ্যায়। সে-পরিশ্রমটা তোমাদের করতে হবে না, উপযুক্ত লোক আসছে।
মহাপঞ্চক। তোমরা মিথ্যা বিচলিত হচ্ছ। বাইরের প্রাচীর ভাঙতে পারে, কিন্তু ভিতরের লোহার দরজা বন্ধ আছে। সে যখন ভাঙবে তখন চন্দ্রসূর্য নিবে যাবে। আমি অভয় দিচ্ছি তোমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অচলায়তনের রক্ষক-দেবতার আশ্চর্য শক্তি দেখে নাও।
উপাধ্যায়। তার চেয়ে দেখি কোন্ দিক দিয়ে বেরোবার রাস্তা।
তৃণাঞ্জন। আমাদেরও তো সেই ইচ্ছা। কিন্তু এখান থেকে বেরোবার পথ যে জানিই নে। কোনোদিন বেরোতে হবে বলে স্বপ্নেও মনে করি নি।
সঞ্জীব। শুনছ—ঐ শুনছ, ভেঙে পড়ল সব।
ছাত্রগণ। কী হবে আমাদের! নিশ্চয় দরজা ভেঙেছে।
তৃণাঞ্জন। ধরো মহাপঞ্চককে। বাঁধো ওকে। একজটা দেবীর কাছে ওকে বলি দেবে চলো।
মহাপঞ্চক। সেই কথাই ভালো। দেবীর কাছে আমাকে বলি দেবে চলো। তাঁর রোষ শান্তি হবে। এমন নিষ্পাপ বলি তিনি আর পাবেন কোথায়।
বালকদলের প্রবেশ
উপাধ্যায়। কী রে তোরা সব নৃত্য করছিস কেন?
প্রথম বালক। আজ এ কী মজা হল!
উপাধ্যায়। মজাটা কী রকম শুনি?
দ্বিতীয় বালক। আজ চার দিক থেকেই আলো আসছে—সব যেন ফাঁক হয়ে গেছে।
তৃতীয় বালক। এত আলো তো আমরা কোনোদিন দেখি নি।
প্রথম বালক। কোথাকার পাখির ডাক এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বালক। এ-সব পাখির ডাক আমরা তো কোনোদিন শুনি নি। এ তো আমাদের খাঁচার ময়নার মতো একেবারেই নয়।
প্রথম বালক। আজ আমাদের খুব ছুটতে ইচ্ছে করছে। তাতে কি দোষ হবে মহাপঞ্চকদাদা!
মহাপঞ্চক। আজকের কথা ঠিক বলতে পারছি নে। আজ কোনো নিয়ম রক্ষা করা চলবে বলে বোধ হচ্ছে না।
প্রথম বালক। আজ তা হলে আমাদের ষড়াসন বন্ধ?
মহাপঞ্চক। হাঁ, বন্ধ।
সকলে। ওরে কী মজা রে মজা!
দ্বিতীয় বালক। আজ পংক্তিধৌতির দরকার নেই?
মহাপঞ্চক। না।
সকলে। ওরে কী মজা! আঃ আজ চারিদিকে কী আলো।
জয়োত্তম। আমারও মনটা নেচে উঠেছে বিশ্বম্ভর। এ কি ভয়, না আনন্দ, কিছুই বুঝতে পারছি নে।
বিশ্বম্ভর। আজ একটা অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে জয়োত্তম।
সঞ্জীব। কিন্তু ব্যাপারটা যে কী ভেবে উঠতে পারছি নে। ওরে ছেলেগুলো, তোরা হঠাৎ এত খুশি হয়ে উঠলি কেন বল্ দেখি।
প্রথম বালক। দেখছ না সমস্ত আকাশটা যেন ঘরের মধ্যে দৌড়ে এসেছে।
দ্বিতীয় বালক। মনে হচ্ছে ছুটি—আমাদের ছুটি।
তৃতীয় বালক। সকাল থেকে পঞ্চকদাদার সেই গানটা কেবলই আমরা গেয়ে বেড়াচ্ছি।
জয়োত্তম। কোন্ গান?
প্রথম বালক। সেই যে—
গান
আলো, আমার আলো, ওগো
আলো ভুবনভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার
আলো হৃদয়হরা।
নাচে আলো নাচে—ও ভাই
   আমার প্রাণের কাছে,
বাজে আলো বাজে—ও ভাই
হৃদয়-বীণার মাঝে;
জাগে আকাশ ছোটে বাতাস
হাসে সকল ধরা।
আলো, আমার আলো, ওগো
আলো ভুবনভরা।
আলোর স্রোতে পাল তুলেছে
হাজার প্রজাপতি।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে
মল্লিকা মালতী।
মেঘে মেঘে সোনা—ও ভাই
   যায় না মানিক গোনা,
   পাতায় পাতায় হাসি—ও ভাই
পুলক রাশি রাশি,
সুরনদীর কূল ডুবেছে
সুধা-নিঝর-ঝরা।
আলো, আমার আলো, ওগো
আলো ভুবনভরা।
[ বালকদের প্রস্থান
জয়োত্তম। দেখো মহাপঞ্চকদাদা, আমার মনে হচ্ছে ভয় কিছুই নেই—নইলে ছেলেদের মন এমন অকারণে খুশি হয়ে উঠল কেন।
মহাপঞ্চক। ভয় নেই সে তো আমি বরাবর বলে আসছি।
শঙ্খবাদক ও মালীর প্রবেশ
উভয়ে। গুরু আসছেন।
সকলে। গুরু!
মহাপঞ্চক। শুনলে তো। আমি নিশ্চয় জানতুম তোমার আশঙ্কা বৃথা।
সকলে। ভয় নেই আর ভয় নেই।
তৃণাঞ্জন। মহাপঞ্চক যখন আছেন তখন কি আমাদের ভয় থাকতে পারে।
সকলে। জয় আচার্য মহাপঞ্চকের।
যোদ্ধৃবেশে দাদাঠাকুরের প্রবেশ
শঙ্খবাদক ও মালী। (প্রণাম করিয়া) জয় গুরুজির জয়।
সকলে স্তম্ভিত
মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, এই কি গুরু?
উপাধ্যায়। তাই তো শুনছি।
মহাপঞ্চক। তুমি কি আমাদের গুরু?
দাদাঠাকুর। হাঁ। তুমি আমাকে চিনবে না, কিন্তু আমিই তোমাদের গুরু।
মহাপঞ্চক। তুমি গুরু? তুমি আমাদের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে এ কোন্ পথ দিয়ে এলে! তোমাকে কে মানবে?
দাদাঠাকুর। আমাকে মানবে না জানি, কিন্তু আমিই তোমাদের গুরু।
মহাপঞ্চক। তুমি গুরু? তবে এই শত্রুবেশে কেন?
দাদাঠাকুর। এই তো আমার গুরুর বেশ। তুমি যে আমার সঙ্গে লড়াই করবে—সেই লড়াই আমার গুরুর অভ্যর্থনা।
মহাপঞ্চক। কেন তুমি আমাদের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে এলে।
দাদাঠাকুর। তুমি কোথাও তোমার গুরুর প্রবেশের পথ রাখ নি।
মহাপঞ্চক। তুমি কি মনে করেছ তুমি অস্ত্র হাতে করে এসেছ বলে আমি তোমার কাছে হার মানব।
দাদাঠাকুর। না, এখনই না। কিন্তু দিনে দিনে হার মানতে হবে, পদে পদে।
মহাপঞ্চক। আমাকে নিরস্ত্র দেখে ভাবছ আমি তোমাকে আঘাত করতে পারি নে?
দাদাঠাকুর। আঘাত করতে পার কিন্তু আহত করতে পার না—আমি যে তোমার গুরু।
মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, তোমরা এঁকে প্রণাম করবে নাকি?
উপাধ্যায়। দয়া করে উনি যদি আমাদের প্রণাম গ্রহণ করেন তা হলে প্রণাম করব বৈকি—তা নইলে যে—
মহাপঞ্চক। না, আমি তোমাকে প্রণাম করব না।
দাদাঠাকুর। আমি তোমার প্রণাম গ্রহণ করব না—আমি তোমাকে প্রণত করব।
মহাপঞ্চক। তুমি আমাদের পূজা নিতে আস নি?
দাদাঠাকুর। আমি তোমাদের পূজা নিতে আসি নি, অপমান নিতে এসেছি।
মহাপঞ্চক। তোমার পশ্চাতে অস্ত্রধারী এ কারা?
দাদাঠাকুর। এরা আমার অনুবর্তী—এরা শোণপাংশু।
সকলে। শোণপাংশু!
মহাপঞ্চক। এরাই তোমার অনুবর্তী?
দাদাঠাকুর। হাঁ।
মহাপঞ্চক। এই মন্ত্রহীন কর্মকাণ্ডহীন ম্লেচ্ছদল!
দাদাঠাকুর। এসো তো, তোমাদের মন্ত্র এদের শুনিয়ে দাও। এদের কর্মকাণ্ড কী রকম তাও ক্রমে দেখতে পাবে।
শোণপাংশুদের গান
যিনি    সকল কাজের কাজি, মোরা
            তাঁরি কাজের সঙ্গী।
যাঁর    নানারঙের রঙ্গ, মোরা
             তাঁরি রসের রঙ্গী।
তাঁর     বিপুল ছন্দে ছন্দে
মোরা     যাই চলে আনন্দে,
তিনি    যেমনি বাজান ভেরী, মোদের
            তেমনি নাচের ভঙ্গি।
এই     জন্মমরণ-খেলায়
মোরা    মিলি তাঁরি মেলায়
এই      দুখ:সুখের জীবন মোদের
            তাঁরি খেলার অঙ্গী।
ওরে,    ডাকেন তিনি যবে
তাঁর     জলদমন্দ্র রবে
ছুটি     পথের কাঁটা পায়ে দ’লে
            সাগরগিরি লঙ্ঘি।
মহাপঞ্চক। আমি এই আয়তনের আচার্য—আমি তোমাকে আদেশ করছি তুমি এখন ওই ম্লেচ্ছদলকে সঙ্গে নিয়ে বাহির হয়ে যাও।
দাদাঠাকুর। আমি যাকে আচার্য নিযুক্ত করব সেই আচার্য; আমি যা আদেশ করব সেই আদেশ।
মহাপঞ্চক। উপাধ্যায়, আমরা এমন করে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এসো আমরা এদের এখান থেকে বাহির করে দিয়ে আমাদের আয়তনের সমস্ত দরজাগুলো আবার একবার দ্বিগুণ দৃঢ় করে বন্ধ করি।
উপাধ্যায়। এরাই আমাদের বাহির করে দেবে, সেই সম্ভাবনাটাই প্রবল বলে বোধ হচ্ছে!
প্রথম শোণপাংশু। অচলায়তনের দরজার কথা বলছ—সে আমরা আকাশের সঙ্গে দিব্যি সমান করে দিয়েছি।
উপাধ্যায়। বেশ করেছ ভাই। আমাদের ভারি অসুবিধা হচ্ছিল। এত তালা-চাবির ভাবনাও ভাবতে হত!
মহাপঞ্চক। পাথরের প্রাচীর তোমরা ভাঙতে পার, লোহার দরজা তোমরা খুলতে পার, কিন্তু আমি আমার ইন্দ্রিয়ের সমস্ত দ্বার রোধ করে এই বসলুম—যদি প্রায়োপবেশনে মরি তবু তোমাদের হাওয়া তোমাদের আলো লেশমাত্র আমাকে স্পর্শ করতে দেব না।
প্রথম শোণপাংশু। এ পাগলটা কোথাকার রে! এই তলোয়ারের ডগা দিয়ে ওর মাথার খুলিটা একটু ফাঁক করে দিলে ওর বুদ্ধিতে একটু হাওয়া লাগতে পারে।
মহাপঞ্চক। কিসের ভয় দেখাও আমায়? তোমরা মেরে ফেলতে পার, তার বেশি ক্ষমতা তোমাদের নেই।
প্রথম শোণপাংশু। ঠাকুর, এই লোকটাকে বন্দী করে নিয়ে যাই—আমাদের দেশের লোকের ভারি মজা লাগবে।
দাদাঠাকুর। ওকে বন্দী করবে তোমরা? এমন কী বন্ধন তোমাদের হাতে আছে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। ওকে কি কোনো শাস্তিই দেব না।
দাদাঠাকুর। শাস্তি দেবে! ওকে স্পর্শ করতেও পারবে না। ও আজ যেখানে বসেছে সেখানে তোমাদের তলোয়ার পৌঁছয় না।
বালকদলের প্রবেশ
সকলে। তুমি আমাদের গুরু?
দাদাঠাকুর। হাঁ, আমি তোমাদের গুরু।
সকলে। আমরা প্রণাম করি।
দাদাঠাকুর। বৎস, তোমরা মহাজীবন লাভ করো।
প্রথম বালক। ঠাকুর, তুমি আমাদের কী করবে।
দাদাঠাকুর। আমি তোমাদের সঙ্গে খেলব।
সকলে। খেলবে!
দাদাঠাকুর। নইলে তোমাদের গুরু হয়ে সুখ কিসের।
সকলে। কোথায় খেলবে?
দাদাঠাকুর। আমার খেলার মস্ত মাঠ আছে।
প্রথম বালক। মস্ত। এই ঘরের মতো মস্ত?
দাদাঠাকুর। এর চেয়ে অনেক বড়ো।
দ্বিতীয় বালক। এর চেয়েও বড়ো? ওই আঙিনাটার মতো?
দাদাঠাকুর। তার চেয়েও বড়ো।
দ্বিতীয় বালক। তার চেয়েও বড়ো! উঃ কী ভয়ানক!
প্রথম বালক। সেখানে খেলতে গেলে পাপ হবে না?
দাদাঠাকুর। কিসের পাপ।
দ্বিতীয় বালক। খোলা জায়গায় গেলে পাপ হয় না?
দাদাঠাকুর। না বাছা, খোলা জায়গাতেই সব পাপ পালিয়ে যায়।
সকলে। কখন নিয়ে যাবে।
দাদাঠাকুর। এখানকার কাজ শেষ হলে।
জয়োত্তম। (প্রণাম করিয়া) প্রভু, আমিও যাব।
বিশ্বম্ভর। সঞ্জীব, আর দ্বিধা করলে কেবল সময় নষ্ট হবে। প্রভু, ওই বালকদের সঙ্গে আমাদেরও ডেকে নাও।
সজ্ঞীব। মহাপঞ্চকদাদা, তুমি এসো না!
মহাপঞ্চক। না, আমি না।

দর্ভকপল্লী
গান
পঞ্চক।                               আমি যে  সব নিতে চাই, সব নিতে ধাই রে।
আমি    আপনাকে ভাই মেলব যে বাইরে।
         পালে আমার লাগল হাওয়া,
         হবে আমার সাগর যাওয়া,
ঘাটে তরী নাই বাঁধা নাই রে।
         সুখে দুখে বুকের মাঝে
         পথের বাঁশি কেবল বাজে,
সকল কাজে শুনি যে তাই রে।
         পাগলামি আজ লাগল পাখায়,
         পাখি কি আর থাকবে শাখায়?
দিকে দিকে সাড়া যে পাই রে।
আচার্যের প্রবেশ
পঞ্চক। দূরে থেকে নানাপ্রকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আচার্যদেব! অচলায়তনে বোধ হয় খুব সমারোহ চলছে।
আচার্য। সময় তো হয়েছে। কালই তো তাঁর আসবার কথা ছিল। আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। একবার সূতসোমকে ওখানে পাঠিয়ে দিই।
পঞ্চক। তিনি আজ একাদশীর তর্পণ করবেন বলে কোথায় ইন্দ্রতৃণ পাওয়া যায় সেই খোঁজে বেরিয়েছেন।
দর্ভকদলের প্রবেশ
পঞ্চক। কী ভাই, তোরা এত ব্যস্ত কিসের?
প্রথম দর্ভক। শুনছি অচলায়তনে কারা সব লড়াই করতে এসেছে।
আচার্য। লড়াই কিসের? আজ তো গুরু আসবার কথা।
দ্বিতীয় দর্ভক। না না, লড়াই হচ্ছে খবর পেয়েছি। সমস্ত ভেঙেচুরে একাকার করে দিলে যে।
তৃতীয় দর্ভক। বাবাঠাকুর, তোমরা যদি হুকুম কর আমরা যাই ঠেকাই গিয়ে।
আচার্য। ওখানে তো লোক ঢের আছে, তোমাদের ভয় নেই বাবা।
প্রথম দর্ভক। লোক তো আছে কিন্তু তারা লড়াই করতে পারবে কেন?
দ্বিতীয় দর্ভক। শুনেছি কতরকম মন্ত্রলেখা তাগাতাবিজ দিয়ে তারা দুখানা হাত আগাগোড়া কষে বেঁধে রেখেছে। খোলে না, পাছে কাজ করতে গেলেই তাদের হাতের গুণ নষ্ট হয়।
পঞ্চক। আচার্যদেব, এদের সংবাদটা সত্যই হবে। কাল সমস্ত রাত মনে হচ্ছিল চারদিকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন ভেঙেচুরে পড়ছে। ঘুমের ঘোরে ভাবছিলুম স্বপ্ন বুঝি।
আচার্য। তবে কি গুরু আসেন নি?
পঞ্চক। হয়তো বা দাদা ভুল করে আমার গুরুরই সঙ্গে লড়াই বাধিয়ে বসেছেন! আটক নেই। রাত্রে তাঁকে হঠাৎ দেখে হয়তো যমদূত বলে ভুল করেছিলেন।
প্রথম দর্ভক। আমরা শুনেছি কে বলছিল গুরুও এসেছেন।
আচার্য। গুরুও এসেছেন! সে কী রকম হল!
পঞ্চক। তবে লড়াই করতে কারা এসেছে বল্ তো?
প্রথম দর্ভক। লোকের মুখে শুনি তাদের নাকি বলে দাদাঠাকুরের দল।
পঞ্চক। দাদাঠাকুরের দল! বল্ বল্ শুনি, ঠিক বলছিস তো রে?
দ্বিতীয় দর্ভক। হাঁ, সকলেই তো বলছে দাদাঠাকুরের দল।
পঞ্চক। ওরে কী আনন্দ রে কী আনন্দ!
আচার্য। একি পঞ্চক, হঠাৎ তুমি এ রকম উন্মত্ত হয়ে উঠলে কেন?
পঞ্চক। প্রভু, আমার মনের একটা বাসনা ছিল কোনো সুযোগে যদি আমাদের দাদাঠাকুরের সঙ্গে গুরুর মিলন করিয়ে দিতে পারি, তাহলে দেখে নিই কে হারে কে জেতে!
আচার্য। পঞ্চক, তোমার কথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি নে। তুমি দাদাঠাকুর বলছ কাকে?
পঞ্চক। আচার্যদেব, ঐটে আমার গোপন কথা, অনেকদিন থেকেই মনে রেখে দিয়েছি। এখন তোমাকে বলব না প্রভু, যদি তিনি এসে থাকেন তাহলে একেবারে চোখে চোখে মিলিয়ে দেব।
প্রথম দর্ভক। বাবাঠাকুর, হুকুম করো, একবার ওদের সঙ্গে লড়ে আসি—দেখিয়ে দিই এখানে মানুষ আছে।
পঞ্চক। আয় না ভাই আমিও তোদের সঙ্গে চলব রে।
দ্বিতীয় দর্ভক। তুমিও লড়বে নাকি ঠাকুর?
পঞ্চক। হাঁ, লড়ব।
আচার্য। কী বলছ পঞ্চক! তোমাকে লড়তে কে ডাকছে!
পঞ্চক। আমার প্রাণ ডাকছে। একটা কিসের মায়াতে মন জড়িয়ে রয়েছে প্রভু। যেন কেবলই স্বপ্ন দেখছি— আর যতই জোর করছি কিছুতেই জাগতে পারছি নে। কেবল এমন বসে বসে হবে না দেব! একেবারে লড়াইয়ের মাঝখানে গিয়ে পড়তে না পারলে কিছুতেই এ ঘোর কাটবে না।
গান
                আর নহে আর নয়।
আমি       করি নে আর ভয়।
আমার      ঘুচল বাঁধন ফলল সাধন
            হল বাঁধন ক্ষয়।
ওই        আকাশে ওই ডাকে,
আমায়      আর কে ধরে রাখে।
আমি       সকল দুয়ার খুলেছি আজ
            যাব সকলময়।
ওরা       বসে বসে মিছে
শুধু        মায়াজাল গাঁথিছে,
ওরা        কী যে গোনে ঘরের কোণে
            আমায় ডাকে পিছে।
আমার      অস্ত্র হল গড়া,
আমার      বর্ম হল পরা,
এবার       ছুটবে ঘোড়া পবনবেগে
            করবে ভুবন জয়।
মালীর প্রবেশ
মালী। আচার্যদেব, আমাদের গুরু আসছেন।
আচার্য। বলিস কী! গুরু? তিনি এখানে আসছেন? আমাকে আহ্বান করলেই তো আমি যেতুম।
প্রথম দর্ভক। এখানে তোমাদের গুরু এলে তাঁকে বসাব কোথায়!
দ্বিতীয় দর্ভক। বাবাঠাকুর, তুমি এখানে তাঁর বসবার জায়গাকে একটু শোধন করে নাও—আমরা তফাতে সরে যাই।
আর-একদল দর্ভকের প্রবেশ
প্রথম দর্ভক। বাবাঠাকুর, এ তোমাদের গুরু নয়—সে এ পাড়ায় আসবে কেন! এ যে আমাদের গোঁসাই!
দ্বিতীয় দর্ভক। আমাদের গোঁসাই?
প্রথম দর্ভক। হাঁ রে হাঁ, আমাদের গোঁসাই। এমন সাজ তার আর কখনো দেখি নি! একেবারে চোখ ঝলসে যায়।
তৃতীয় দর্ভক। ঘরে কী আছে রে ভাই সব বের কর্।
দ্বিতীয় দর্ভক। বনের জাম আছে রে।
চতুর্থ দর্ভক। আমার ঘরে খেজুর আছে।
প্রথম দর্ভক। কালো গোরুর দুধ শিগ্গির দুয়ে আনো দাদা।
দাদাঠাকুরের প্রবেশ
আচার্য। (প্রণাম করিয়া) জয় গুরুজির জয়!
পঞ্চক। এ কী! এ যে দাদাঠাকুর! গুরু কোথায়?
দর্ভকদল। গোঁসাইঠাকুর! প্রণাম হই। খবর দিয়ে এলে না কেন? তোমার ভোগ যে তৈরি হয় নি।
দাদাঠাকুর। কেন ভাই, তোদের ঘরে আজ রান্না চড়ে নি নাকি? তোরাও মন্ত্র নিয়ে উপোস করতে আরম্ভ করেছিস নাকি রে?
প্রথম দর্ভক। আমরা আজ শুধু মাষকলাই আর ভাত চড়িয়েছি। ঘরে আর কিছু ছিল না।
দাদাঠাকুর। আমারও তাতেই হয়ে যাবে।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, আমার ভারি গর্ব ছিল এ রাজ্যে একলা আমিই কেবল চিনি তোমাকে। কারও যে চিনতে আর বাকি নেই।
প্রথম দর্ভক। ওই তো আমাদের গোঁসাই, পূর্ণিমার দিনে এসে আমাদের পিঠে খেয়ে গেছে, তার পর এই কতদিন পরে দেখা। চল্ ভাই, আমাদের যা আছে সব সংগ্রহ করে আনি।
[ প্রস্থান
দাদাঠাকুর। আচার্য, তুমি এ কী করেছ?
আচার্য। কী যে করেছি তা বোঝবারও শক্তি আমার নেই। তবে এইটুকু বুঝি—আমি সব নষ্ট করেছি।
দাদাঠাকুর। যিনি তোমাকে মুক্তি দেবেন তাঁকেই তুমি কেবল বাঁধবার চেষ্টা করেছ।
আচার্য। কিন্তু বাঁধতে তো পারি নি ঠাকুর। তাঁকে বাঁধছি মনে করে যতগুলো পাক দিয়েছি সব পাক কেবল নিজের চারিদিকেই জড়িয়েছি। যে হাত দিয়ে সেই বাঁধন খোলা যেতে পারত সেই হাতটা সুদ্ধ বেঁধে ফেলেছি।
দাদাঠাকুর। যিনি সব জায়গায় আপনি ধরা দিয়ে বসে আছেন তাঁকে একটা জায়গায় ধরতে গেলেই তাঁকে হারাতে হয়।
আচার্য। তিনি যে আছেন এই খবরটা মনের মধ্যে পৌঁছায় নি বলেই মনে করে বসেছিলুম তাঁকে বুঝি কৌশল করে গড়ে তুলতে হয়। তাই দিনরাত বসে বসে এত ব্যর্থচেষ্টার জাল পাকিয়েছি।
দাদাঠাকুর। তোমার যে কারাগারটাতে তোমার নিজেকেই আঁটে না সেইখানে তাঁকে শিকল পরাবার আয়োজন না করে তাঁরই এই খোলা মন্দিরের মধ্যে তোমার আসন পাতবার জন্যে প্রস্তুত হও।
আচার্য। আদেশ করো প্রভু। ভুল করেছিলুম জেনেও সে ভুল ভাঙতে পারি নি। পথ হারিয়েছি তা জানতুম, যতই চলছি ততই পথ হতে কেবল বেশি দূরে গিয়ে পড়ছি তাও বুঝতে পেরেছিলুম, কিন্তু ভয়ে থামতে পারছিলুম না। এই চক্রে হাজার বার ঘুরে বেড়ানোকেই পথ খুঁজে পাবার উপায় বলে মনে করেছিলুম।
দাদাঠাকুর। যে-চক্র কেবল অভ্যাসের চক্র, যা কোনো জায়গাতেই নিয়ে যায় না, কেবল নিজের মধ্যেই ঘুরিয়ে মারে, তার থেকেই বের করে সোজা রাস্তায় বিশ্বের সকল যাত্রীর সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্যেই আমি আজ এসেছি।
আচার্য। ধন্য করেছ। কিন্তু এতদিন আস নি কেন প্রভু? আমাদের আয়তনের পাশেই এই দর্ভকপাড়ায় তুমি আনাগোনা করছ আর কত বৎসর হয়ে গেল আমাদের আর দেখা দিলে না!
দাদাঠাকুর। এদের দেখা দেওয়ার রাস্তা যে সোজা। তোমাদের সঙ্গে দেখা করা তো সহজ করে রাখ নি।
পঞ্চক। ভালোই করেছি, তোমার শক্তি পরীক্ষা করে নিয়েছি। তুমি আমাদের পথ সহজ করে দেবে কিন্তু তোমার পথ সহজ নয়। এখন, আমি ভাবছি তোমাকে ডাকব কী বলে? দাদাঠাকুর, না গুরু?
দাদাঠাকুর। যে জানতে চায় না যে আমি তাকে চালাচ্ছি আমি তার দাদাঠাকুর, আর যে আমার আদেশ নিয়ে চলতে চায় আমি তার গুরু।
পঞ্চক। প্রভু, তুমি তাহলে আমার দুইই। আমাকে আমিই চালাচ্ছি, আর আমাকে তুমিই চালাচ্ছ এই দুটোই আমি মিশিয়ে জানতে চাই। আমি শোণপাংশু না, তোমাকে মেনে চলতে ভয় নেই। তোমার মুখের আদেশকেই আনন্দে আমার মনের ইচ্ছা করে তুলতে পারব। এবার তবে তোমার সঙ্গে তোমারই বোঝা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ঠাকুর।
দাদাঠাকুর। আমি তোমার জায়গা ঠিক করে রেখেছি।
পঞ্চক। কোথায় ঠাকুর?
দাদাঠাকুর। ওই অচলায়তনে।
পঞ্চক। আবার অচলায়তনে! আমার কারাদণ্ডের মেয়াদ ফুরোয় নি?
দাদাঠাকুর। কারাগার যা ছিল সে তো আমি ভেঙে ফেলেছি, এখন সেই উপকরণ দিয়ে সেইখানেই তোমাকে মন্দির গেঁথে তুলতে হবে।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমি তোমাকে জোড়হাত করে বলছি, আর আমাকে বসিয়ে রাখার কাজে লাগিয়ো না। তোমার ঐ বীরবেশে আমার মন ভুলেছে—তোমাকে এমন মনোহর আর কখনো দেখি নি।
দাদাঠাকুর। ভয় নেই পঞ্চক। অচলায়তনে আর সেই শান্তি দেখতে পাবে না। তার দ্বার ফুটো করে দিয়ে আমি তার মধ্যেই লড়াইয়ের ঝোড়ো হাওয়া এনে দিয়েছি। নিজের নাসাগ্রভাগের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে থাকবার দিন এখন চিরকালের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছি।
পঞ্চক। কিন্তু অচলায়তনের লোকে যে আমাকে আপন বলে গ্রহণ করবে না প্রভু।
দাদাঠাকুর। আমি বলছি তুমি অচলায়তনের লোকের সকলের চেয়ে আপন।
পঞ্চক। কিন্তু দাদাঠাকুর, আমি কেবল একলা, একলা, ওরা আমাকে সবাই ঠেলে রেখে দেবে।
দাদাঠাকুর। ওরা তোমাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না, সেইজন্যেই ওখানে তোমার সবচেয়ে দরকার। ওরা তোমাকে ঠেলে দিচ্ছে বলেই তুমি ওদের ঠেলতে পারবে না।
পঞ্চক। আমাকে কী করতে হবে?
দাদাঠাকুর। যে যেখানে ছড়িয়ে আছে সবাইকে ডাক দিয়ে আনতে হবে।
পঞ্চক। সবাইকে কি কুলোবে?
দাদাঠাকুর। না যদি কুলোয় তাহলে এমনি করে দেয়াল আবার আর-একদিন ভাঙতেই হবে সেই বুঝে গেঁথো—আমার আর কাজ বাড়িয়ো না।
পঞ্চক। শোণপাংশুদের—
দাদাঠাকুর । হাঁ, ওদেরও ডেকে এনে বসাতে হবে, ওরা একটু বসতে শিখুক।
পঞ্চক। ওদের বসিয়ে রাখা! সর্বনাশ! তার চেয়ে ওদের ভাঙতে চুরতে দিলে ওরা বেশি ঠাণ্ডা থাকে। ওরা যে কেবল ছটফট করাকেই মুক্তি মনে করে।
দাদাঠাকুর। ছোটো ছেলেকে পাকা বেল দিলে সে ভারি খুশি হয়ে মনে করে এটা খেলার গোলা। কেবল সেটাকে গড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওরাও সেইরকম স্বাধীনতাকে বাইরে থেকে ভারি একটা মজার জিনিস বলে জানে—কিন্তু জানে না স্থির হয়ে বসে তার ভিতর থেকে সার পদার্থটা বের করে নিতে হয়। কিছুদিনের জন্যে তোমার মহাপঞ্চকদাদার হাতে ওদের ভার দিলেই খানিকটা ঠাণ্ডা হয়ে ওরা নিজের ভিতরের দিকটাতে পাক ধরাবার সময় পাবে।
পঞ্চক। তাহলে আমার মহাপঞ্চকদাদাকে কি ঐখানেই—
দাদাঠাকুর। হাঁ ঐখানেই বৈকি। তার ওখানে অনেক কাজ। এতদিন ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে ও মনে করছিল চাকাটা খুব চলছে, কিন্তু চাকাটা কেবল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরছিল তা সে দেখতেও পায় নি। এখন আলোতে তার দৃষ্টি খুলে গেছে, সে আর
সে-মানুষ নেই। কী করে আপনাকে আপনি ছাড়িয়ে উঠতে হয় সেইটে শেখাবার ভার ওর উপর। ক্ষুধাতৃষ্ণা-লোভভয়-জীবনমৃত্যুর আবরণ বিদীর্ণ করে আপনাকে প্রকাশ করার রহস্য ওর হাতে আছে।
আচার্য। আর এই চির-অপরাধীর কী বিধান করলে প্রভু?
দাদাঠাকুর। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না আচার্য। তুমি আমার সঙ্গে এসো।
আচার্য। বাঁচালে প্রভু, আমাকে রক্ষা করলে। আমার সমস্ত চিত্ত শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে—আমাকে আমারই এই পাথরের বেড়া থেকে বের করে আনো। আমি কোনো সম্পদ চাই নে—আমাকে একটু রস দাও।
দাদাঠাকুর। ভাবনা নেই আচার্য, ভাবনা নেই—আনন্দের বর্ষা নেমে এসেছে—তার ঝর ঝর শব্দে মন নৃত্য করছে আমার। বাইরে বেরিয়ে এলেই দেখতে পাবে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। ঘরে বসে ভয়ে কাঁপছে কারা। এ ঘনঘোর বর্ষার কালো মেঘে আনন্দ, তীক্ষ্ণ বিদ্যুতে আনন্দ, বজ্রের গর্জনে আনন্দ। আজ মাথার উষ্ণীষ যদি উড়ে যায় তো যাক, গায়ের উত্তরীয় যদি ভিজে যায় তো ভিজে যাক—আজ দুর্যোগ একে বলে কে! আজ ঘরের ভিত যদি ভেঙে গিয়ে থাকে যাক না—আজ একেবারে বড়ো রাস্তার মাঝখানে হবে মিলন।
সুভদ্রের প্রবেশ
সুভদ্র। গুরু!
দাদাঠাকুর। কী বাবা?
সুভদ্র। আমি যে-পাপ করেছি তার তো প্রায়শ্চিত্ত শেষ হল না!
দাদাঠাকুর। তার আর কিছু বাকি নেই।
সুভদ্র। বাকি নেই?
দাদাঠাকুর। না। আমি সমস্ত চুরমার করে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছি।
সুভদ্র। একজটা দেবী—
দাদাঠাকুর। একজটা দেবী! উত্তরের দিকের দেয়ালটা ভাঙবামাত্রই একজটা দেবীর সঙ্গে আমাদের এমনি মিল হয়ে গেল যে, সে আর কোনোদিন জটা দুলিয়ে কাউকে ভয় দেখাবে না। এখন তাকে দেখলে মনে হবে সে আকাশের আলো—তার সমস্ত জটা আষাঢ়ের নবীন মেঘের মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছে।
সুভদ্র। এখন আমি কী করব।
পঞ্চক। এখন তুমি আছ ভাই আর আমি আছি। দুজনে মিলে কেবলই উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিমের সমস্ত দরজা-জানলাগুলো খুলে খুলে বেড়াব।
উপাচার্য। (প্রবেশ করিয়া) তৃণ পাওয়া গেল না—কোথাও তৃণ পাওয়া গেল না।
আচার্য। সূতসোম, তুমি বুঝি তৃণ খুঁজেই বেড়াচ্ছিলে?
উপাচার্য। হাঁ, ইন্দ্রতৃণ, সে তো কোথাও পাওয়া গেল না। হায় হায়! এখন আমি করি কী! এমন জায়গাতেও মানুষ বাস করে!
আচার্য। থাক তোমার তৃণ। এদিকে একবার চেয়ে দেখো।
উপাচার্য। এ কী! এ যে আমাদের গুরু! এখানে! এই দর্ভকদের পাড়ায়! এখন উপায় কী! ওঁকে কোথায়—
দর্ভকগণের অর্ঘ্য লইয়া প্রবেশ
প্রথম দর্ভক। গোঁসাই, এই-সব তোমার জন্যে এনেছি। কেতনের মাসি পরশু পিঠে তৈরি করেছিল, তার কিছু বাকি আছে—
উপাচার্য। আরে আরে, সর্বনাশ করলে রে! করিস কী! উনি যে আমাদের গুরু।
দ্বিতীয় দর্ভক। তোমাদের গুরু আবার কোথায়? এ তো আমাদের গোঁসাই।
দাদাঠাকুর। দে ভাই, আর কিছু এনেছিস?
দ্বিতীয় দর্ভক। হাঁ, জাম এনেছি।
তৃতীয় দর্ভক। কিছু দই এনেছি।
দাদাঠাকুর। সব এখানে রাখ্। এসো ভাই পঞ্চক, এসো আচার্য অদীনপুণ্য-নূতন আচার্য আর পুরাতন আচার্য এসো, এদের ভক্তির উপহার ভাগ করে নিয়ে আজকের দিনটাকে সার্থক করি।
বালকগণের প্রবেশ
সকলে। গুরু!
দাদাঠাকুর। এসো বাছা, তোমরা এসো।
প্রথম বালক। কখন আমরা বের হব?
দাদাঠাকুর। আর দেরি নেই —এখনই বের হতে হবে।
দ্বিতীয় বালক। এখন কী করব?
দাদাঠাকুর। এই যে তোমাদের ভোগ তৈরি হয়েছে।
প্রথম বালক। ও ভাই, এই যে জাম—কী মজা।
দ্বিতীয় বালক। ওরে ভাই, খেজুর—কী মজা।
তৃতীয় বালক। গুরু, এতে কোনো পাপ নেই?
দাদাঠাকুর। কিছু না—পূণ্য আছে।
প্রথম বালক। সকলের সঙ্গে এইখানে বসে খাব?
দাদাঠাকুর। হাঁ এইখানেই।
শোণপাংশুদলের প্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। দাদাঠাকুর।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আর তো পারি নে। দেয়াল তো একটাও বাকি রাখি নি। এখন কী করব? বসে বসে পা ধরে গেল যে।
দাদাঠাকুর। ভয় নেই রে। শুধু শুধু বসিয়ে রাখব না। তোদের কাজ দেব।
সকলে। কী কাজ দেবে?
দাদাঠাকুর। আমাদের পঞ্চকদাদার সঙ্গে মিলে ভাঙা ভিতের উপর আবার গাঁথতে লেগে যেতে হবে।
সকলে। বেশ, বেশ, রাজি আছি।
দাদাঠাকুর। ওই ভিতের উপর কাল যুদ্ধের রাত্রে স্থবিরকের রক্তের সঙ্গে শোণপাংশুর রক্ত মিলে গিয়েছে।
সকলে। হাঁ মিলেছে।
দাদাঠাকুর। সেই মিলনেই শেষ করলে চলবে না। এবার আর লাল নয়, এবার একেবারে শুভ্র। নূতন সৌধের সাদা ভিতকে আকাশের আলোর মধ্যে অভ্রভেদী করে দাঁড় করাও। মেলো তোমরা দুইদলে, লাগো তোমাদের কাজে।
সকলে। তাই লাগব। পঞ্চকদাদা, তাহলে তোমাকে উঠতে হচ্ছে, অমন করে ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকলে চলবে না। ত্বরা করো। আর দেরি না।
পঞ্চক। প্রস্তুত আছি। গুরু তবে প্রণাম করি। আচার্যদেব আশীর্বাদ করো।

 সংগৃহীত